এক কেজি মুরগিতে কত টাকা মুনাফা করা যাবে কেউ জানেনা। পোলট্রি খাতে সরকারের কোনো তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকার সুযোগে গত ৫২ দিনে মোট ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মতবিনিময় সভায় দেওয়া হিসাব অনুসারে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের খরচ ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এক কেজি মুরগিতে এর ওপর ১০০ টাকারও বেশি মুনাফা করার বিষয়ে সরকারী কোন সংস্থাই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে কোন অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে না।
আমিষের সস্তা উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগির দাম এ বছরের জানুয়ারিতে ছিল কেজিপ্রতি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। মার্চ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। এভাবে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১০০ টাকারও বেশি দাম বাড়ার কারণে বিপাকে পড়ে সাধারণ ক্রেতারা। নিম্ন আয়ের অনেকেই মুরগি কিনতে না পেরে মুরগির গিলা-কলিজা, গলা ও পা কেনার দিকে ঝুঁকেছেন বলেও সংবাদ প্রকাশ পায়।
ব্রয়লার মুরগির এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা মুরগির বাচ্চা, খাদ্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করলেও তা ছিল বিগত ছয় সাত মাসের চলতি পরিস্থিতি। কিন্তু মাত্র দুই মাসে এই রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কারো কাছেই পাওয়া যায়না। সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে দেওয়া উৎপাদকদের হিসাব অনুযায়ী, মুরগির খাবারসহ অন্যান্য সব ব্যয় বাড়ার পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনব্যয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। অন্যদিকে প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে খরচ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। তাতে বর্তমান উৎপাদনের খরচ অনুযায়ী, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম সর্বোচ্চ কত টাকা হতে পারে সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই কারো।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুরগি বিক্রির ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করছে। শুধু তাই নয়, বড় কোম্পানিগুলো মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে বাচ্চাপ্রতি ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। পোলট্রি খাতে সরকারের কোনো তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকার সুযোগে দৈনিক ২ হাজার টন মুরগি এবং ২০ লাখ বাচ্চা বিক্রিতে এভাবে তারা অতিরিক্ত মুনাফার মাধ্যমে পোলট্রি খাতের করপোরেট কোম্পানিগুলো ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে মোট ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
পোলট্রি খাতে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের অভিযোগ নতুন নয়। বাজার অর্থনীতির নিয়মে বড় পুঁজি প্রতিযোগিতায় ছোট পুঁজির চেয়ে এগিয়ে থাকে, ফলে ক্রমে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের দিক থেকে যদি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা ও তদারকি না থাকে, তাহলে বৃহৎ কোম্পানিগুলো সহজেই বাজারের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে। বাংলাদেশের পোলট্রি খাতে ঠিক এ ঘটনাটিই ঘটেছে। সেই সঙ্গে করোনা মহামারির সময় প্রায় ৪০ শতাংশ মুরগির খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় কোম্পানিগুলোর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি কোম্পানি, সেই সঙ্গে ডিম ও মাংসের বাজারেরও বড় একটি অংশ তাদের দখলে। নিজেরা উৎপাদনের পাশাপাশি চুক্তি ভিত্তিতে অনেক খামারিকে মুরগি পালনের কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। এভাবে মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ডিম ও মাংস উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে গোটা পোলট্রি খাতের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে গুটিকয়েক বৃহৎ কোম্পানি। এর ফলে কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ডিম ও মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ও মূল্যহ্রাস বৃদ্ধি করতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পোলট্রি খাতে বৃহৎ কোম্পানিগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি পদ্ধতি হলো কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক মুরগি পালন। মুরগির খাদ্য ও বাচ্চা উৎপাদনে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণকে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র খামারিদের চুক্তিভিত্তিক মুরগি পালনে বাধ্য করা হয়, যেন মুরগির বাজারের ওপর কোম্পানির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র খামারিদের অভিযোগ হলো, চুক্তিতে না গেলে তাদের কাছে খাবার, বাচ্চা বা ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, বাজারে কন্ট্রাক্ট ও স্বতন্ত্র খামারিদের বাচ্চার দামে পার্থক্য প্রায় দ্বিগুণ। কন্ট্রাক্টে প্রতিটি বাচ্চার দর ৩৫ টাকা ধরা হলেও একই দিনে স্বতন্ত্র খামারিদের জন্য প্রতিটি বাচ্চার দাম ৬৫ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। পোল্ট্রিখাদ্যের দাম কন্ট্রাক্টে ২ হাজার ৬০০ টাকা ধরা হলেও সাধারণ খামারিদের কিনতে হয় ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭৫০ টাকায়। এভাবে তুলনামূলক কম দামে বাচ্চা ও খাবারের সরবরাহ নেয়ার পর মুরগির বিক্রয়মূল্যের ওপর খামারির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
মুরগির বাজারের ওপর বৃহৎ কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে যে প্রতিদিন তারা এসএমএসের মাধ্যমে মুরগি, ডিম, বাচ্চা ও খাবারের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বিক্রির আগের দিন রাতে এই মেসেজ চলে যায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। অনেক সময় ঘণ্টার ব্যবধানেও এই বার্তার মাধ্যমে বাড়িয়ে দেয়া হয় মুরগির দাম। যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে মুরগি থাকে, তখন করপোরেট কোম্পানিগুলো মুরগির দাম কমিয়ে দেয়। এরপর লোকসানে প্রান্তিক খামারিরা মুরগি উৎপাদন কমিয়ে দিলে সরবরাহ আবার কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন আবার দাম বাড়িয়ে দেয়। এ অভিযোগ যে শুধু এবারই প্রথম উঠেছে তাই নয়, ২০২২-এর আগস্টে ১৫ দিনে ডিম, এক দিনের বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে ৫১৮ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফার অভিযোগ উঠেছিল বড় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।
উৎপাদনের খরচের চেয়ে দ্বিগুণ দামে মুরগি বিক্রির অভিযোগ ওঠার পর স্রেফ বড় কোম্পানিগুলো কর্তৃক রোজায় কিছুটা কম দামে বিক্রির প্রতিশ্রুতিতেই সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত করা হল। বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকের পর ঘোষণা দেয় যে তারা রমজান মাসে তাদের খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০-১৯৫ টাকায় বিক্রি করবে। কিন্তু খামার পর্যায়ে এই দামে মুরগি বিক্রি করা হলে কয়েক হাত ঘুরে খুচরা পর্যায়ে এর প্রভাব খুব বেশি পড়েনি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মতবিনিময় সভায় দেওয়া হিসাব অনুসারে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের খরচ ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এক কেজি মুরগিতে এর ওপর ১০০ টাকারও বেশি মুনাফা করার বিষয়ে সরকারী কোন সংস্থাই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে কোন অপরাধ হিসেবে গণ্য করেনি। বরং এই মূল্যবৃদ্ধিকে প্রকারান্তরে বৈধতা দেওয়া হলো বাজারে একচেটিয়াত্বকে পুজি করে অরাজক্তা সৃষ্টিকারীদের সামান্যকিছু দাম কমানের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে। অন্যদিকে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বারবার পোলট্রি খাতে বাজার কারসাজির গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে এসব কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। যার খেসারত বারবার ভক্তাকেই গুনতে হচ্ছে।