ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই মুহূর্তে নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে খুবই কষ্টে রয়েছেন। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই এবারের মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মুদ্রানীতিতেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে।
সত্যি বলতে, আসছে অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কত হবে বা না হবে তারচেয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে- সেই দিকেই বেশি নীতি-মনোযোগ কাম্য। তবে বাজেট প্রস্তাবনায় যেমন দাবি করা হয়েছে সেই ভাবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য অর্জন আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে। কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে চলতি অর্থবছরের প্রথম এগারোটি মাসে কখনোই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে ছিল না।
মুদ্রানীতিকে সঙ্কোচনমূলক রাখার কথাটি বাজেট বক্তৃতায় না এলেও আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের (অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩-এর) মুদ্রানীতিতে এই কথাটি রয়েছে। এর অংশ হিসেবেই সদ্য প্রকাশিত এই ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতিতে বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদ (রেপো, Repurchase Agreement-REPO) হার।
৫০ ব্যাসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬.৫ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে রিভার্স রেপো (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি, এসডিএফ) ৪.২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। স্পেশাল রেপো রেট (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি, এসএলএফ) বাড়িয়ে ৮.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে কলমানি রেটের সাথে রেপো রেট ওঠানামা করবে এখন থেকে।
এছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর নাগাদ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ব্রড মানি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৯.৫ শতাংশ (জুনে ১০.৫ শতাংশ) এবং ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১০.৯ শতাংশ (জুনে ১১ শতাংশ) লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই বেড়েছে সরকারি ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা (জুনে ৪০ শতাংশ থেকে ডিসেম্বর ৪৩ শতাংশ)।
শেষ পর্যন্ত যেমনটি আশা করা হচ্ছিল তেমনই মুদ্রানীতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদের হার ও বিদেশি মুদ্রার সাথে টাকার বিনিময় হারকে বাজার নির্ভর করে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার একটা প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি সদ্য ঘোষিত এই মুদ্রানীতিতে।
মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ফেড ও পশ্চিমের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে সুদের হার বাড়িয়ে চলার নীতির কারণে আমাদের মতো দেশের ম্যাক্রো অর্থনীতিতে মূলত আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
ডলারের দাম বাড়ায় এর চাপ ও তাপ আরও বাড়ে। তাই নীতি সুদহার যথা রেপো রেট ও রিভার্স রেপো রেট বাড়িয়ে মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এবারের মুদ্রানীতিতে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোয় স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিতে হবে।
অন্যদিকে ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখে তাহলে তারা বেশি ডিপোজিট রেট পাবে। এটাও এক ধরনের প্রণোদনা বলা যায়। কারণ ব্যাংকের স্প্রেড এখন রিভার্স রেপো রেটের চেয়ে কম হয়ে যাবে। উভয় কারণেই মুদ্রা সরবরাহ কমে আসবে। এর বাইরে ব্যাংকগুলো প্রতিমাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি রেফারেন্স রেট দেবে।
১৮২ দিনের ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদের ভিত্তিতে প্রতি মাসে এই হার ঘোষণা করা হবে। এর সাথে তিন শতাংশ মার্জিন যোগ করে ব্যাংকের জন্য একটি সুদ করিডোর করা হবে। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই মার্জিন পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ঋণ ও কনজ্যুমার ঋণের জন্য আরও এক শতাংশ সুদ যোগ করা যাবে। রেফারেন্স রেটকে এইভাবে বাজার-নির্ভর করার চেষ্টা করা হবে। আন্তঃব্যাংক কলমানি রেট এই রেফারেন্স রেটের সাথে ওঠানামা করবে। আগের সুদের সিলিং ব্যবস্থার বদলে নতুন এই ব্যবস্থা অনেকটাই নমনীয় ও বাজার-নির্ভর হবে বলে আশা করা যায়।
আগের ব্যবস্থায় ডিপোজিটের হার ছিল ৬ শতাংশ এবং সুদের হার ৯ শতাংশ। এই হার বেঁধে দেওয়া ছিল। এতে করে ব্যাংকের পক্ষে ডিপোজিট সংগ্রহ করাও কষ্টকর হচ্ছিল। নতুন ব্যবস্থায় স্প্রেড হয়তো খানিকটা বাড়বে। আর ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমবে।
আগের বেঁধে দেওয়া নয় শতাংশ সুদ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও কম। তাই বড় বড় উদ্যোক্তারা বলা যায় প্রকৃত সুদের হার নেগেটিভ হওয়ার কারণে যথেচ্ছ ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারও করছিলেন না। ফলে তাদের খেলাপি ঋণও বাড়ছিল। উৎপাদন বা সরবরাহও তাই বাড়ছিল না।
অনেকে বলতে চাইবেন বাজেটকে সম্প্রাসারণমুখী (+১৫ শতাংশ) রেখে মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করে কী লাভ? এর উত্তরে বলা যায় কাগজে কলমে সম্প্রসারণমূলক হলেও শেষ পর্যন্ত বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা যায় না। আর নির্বাচনের এই বছরে তা আরও সম্ভব নয়। তাই বাজেটও সংকোচনমূলকই থেকে যাবে শেষ পর্যন্ত।
মুদ্রানীতি ও বাজেট যদি সংকোচনমূলক থাকে তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সহজ হবে। তবে শুধু চাহিদা কমিয়েই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিনই হবে বলা যায়। কৃষি, দেশীয় শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনা দিয়ে সচল রাখা। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সেইদিকে খেয়াল রাখছে বলেই মনে হয়। সরবরাহ না বাড়ালে পণ্যমূল্য কমানো মোটেও সহজ হবে না। তাই সবদিক থেকেই মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করতে হবে। এখানেই আমদানির কথাটি এসে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি ঠিকমতো খোলা ও তার জন্য ডলার জোগানোর বিষয়টিও সরবরাহের দিক থেকে কম গুরুত্বের নয়। এই দিকটাও খেয়াল রাখা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের সময় চারপাশের এসব দিকেও নজর দেবে।
দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার-নির্ভর বিনিময় হার এবং সুদের করিডোরের মাধ্যমে সময়োচিত সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এগুলো সময়োচিত পদক্ষেপই বলতে হয়। তবে এটাও মানতে হবে যে, এই বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের গতানুগতিক নিয়ম থেকে বের হয়ে আসতেই হবে।
ড. আতিউর রহমান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।