ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: গরিবের আমিষ খাদ্য ডিম এখন দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০২২ সালের এই সময়ে ডিম ও মুরগির বাজারে কারসাজি নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। এবারও বছর না ঘুরতেই আবারও সক্রিয় হলো সেই পুরানো চক্রটি। নানা অজুহাতে আবারও বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করছে। শেষ পর্যন্ত ডিমের দাম এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম উঠেছে সর্বোচ্চ ১৭০ টাকায়। দেশি মুরগির ডিম কোথাও কোথাও প্রতি ডজন ২২০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দাম বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা বলছে অনেক ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকে ডিমের দামের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে মাছের মূল্যবৃদ্ধি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন।
তাদের যুক্তি হলো, মাছের দাম বাড়ায় আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য বিশেষ করে মানুষের বিকল্প পণ্য হিসেবে ডিমের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। চাহিদা বাড়লেও কয়েক মাসের প্রতিবেশগত দুর্যোগের কারণে বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়েনি। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কয়েক ধাপে তীব্র তাপদাহের কারণে পোলট্রি খামারগুলোয় হিটস্ট্রোকে অনেক মুরগি মারা যায়। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানের সাম্প্রতিক বন্যার কারণেও ডিম ও মুরগির সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে।
মানুষ একটা সময় আমিষের জোগানের জন্য মাছের প্রতি নির্ভরশীল হলেও সাধারণ তেলাপিয়া থেকে শুরু করে সব মাছের দামও আকাশচুম্বী। পোল্ট্রি মুরগির দামও হাতের নাগালে নেই। এই ফাঁকে পরিবারের নারী ও শিশুদের মাঝে আমিষের জোগান দিতে ডিমে ঝুঁকলেও ডিম ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ দিচ্ছে না।
২০২২ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কিছু গণমাধ্যমের বদৌলতে ডিমের ব্যবসায় অদৃশ্য এসএমএস দিয়ে পুরো দেশের বাজারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার খবর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর সাভারে কয়েকটি কর্পোরেট গ্রুপের পোল্ট্রি ও ডিমের মজুতদারি নিয়ে তথ্য উদঘাটন করেছিল। পরবর্তীতে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল।
মামলায় কী ফলাফল তা জাতি এখনো জানতে পারেনি। যার কারণে ঘুরে ফিরে এই চক্রটি বারবার ডিমের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন বলে ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামারি এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের অভিযোগ হলেও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর তা কোনোভাবেই আমলে নেয়নি।
ডিমের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের বক্তব্য হলো তারা উৎপাদনের সাথে জড়িত। খামারিদের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের মূল দায়িত্ব। তাই দাম বাড়লেও তাদের কোনো ভূমিকা নেই। ডিম উৎপাদনকারী খামারগুলোর বক্তব্য হলো ডিম উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিড ও ওষুধের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আর উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে লোকসান দিতে গিয়ে অনেক ক্ষুদ্র খামারি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
একদিকে ক্ষুদ্র খামারিরা খামার বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ডিমের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে মাছ ও পোল্ট্রি মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের আমিষের ঘাটতি পূরণে ডিমের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। এই সুযোগটি নিচ্ছেন তথাকথিত ডিম ব্যবসায়ীরা। তারা ঢাকার তেজগাঁওতে বসে পুরো দেশের ডিমের দাম নির্ধারণ করে গায়েবি এসএমএস দিয়ে বাজার অস্থির করছেন।
একটা সময় দেখা যেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র খামারিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে ডিম উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে থাকতো। সেই কারণে ডিমের দামের তারতম্য ছিল। স্থানীয় পর্যায়ে যেহেতু উৎপাদন করে বিপণন করা হতো তখন সেইখানে পরিবহন খরচ অনেক কম পড়তো। এখন আর সেই সুযোগ নেই ঢাকা থেকে গায়েবি এসএমএস দিয়ে দাম নির্ধারণ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঢাকার মতো একই দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি মাছের মূল্যবৃদ্ধিকে বাজারে ডিমের দাম বাড়ার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে মাছ, ডিম ও মুরগি একে অপরের বিকল্প পণ্য হিসেবে কাজ করে। এর কোনো একটির দাম বাড়লে অন্যগুলোর দামেও প্রভাব পড়ে।
২০২২ সালের অগাস্টেও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরবরাহ সংকটের অজুহাতে হুট করে বেড়ে যায় মুরগি ও ডিমের দাম। তখন তেলাপিয়া ও পাঙাশের চাহিদা বেড়ে যেতে দেখা যায়। ডিম, মুরগি ও তেলাপিয়া-পাঙাশ প্রোটিনের মধ্যে এই তিনটি উৎস কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায়।
কয়েক মাসে সবকিছুর দাম যেভাবে বেড়েছে সাধারণ মানুষ এখন সবজি, ভর্তা বা ডিম দিয়ে খাওয়ার পরেও খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে, প্রান্তিক মানুষ তাহলে কী খেয়ে বাঁচবে?
স্বল্প আয়ের মানুষ এই তিনটি থেকেই তাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করে। এগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক। ফলে মাছ ও মাংসের দাম যদি বেশি বেড়ে যায়, তাহলে ডিমের চাহিদাও বেড়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। আবার দাম কমলে সবগুলোর একসঙ্গেই কমবে। যদি একটির সরবরাহ বেড়ে যায় এবং একটির দাম কমে যায়, তাহলে অন্যগুলোও কমে যাবে।
ক্ষুদ্র পোলট্রি খামারিদের এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রান্তিক খামারিগুলোর মুরগি উৎপাদনে ১৬৫-১৭০ টাকা গুনতে হয়। কিন্তু তা বিক্রি করে ১৩০-১৪০ টাকায়। এই কারণে অনেক খামারি লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন বন্যায় আরও অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে।
সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে কর্পোরেটদের আধিপত্য বিস্তারের খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর দাদন ব্যবসার কাছে খামারিরা জিম্মি হয়ে আছেন। তারা মূল্যবৃদ্ধি বা হ্রাসের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের পথে বসিয়ে দিচ্ছেন। আবার বৈশ্বিকভাবে খাদ্য উপকরণের দাম কমলেও দেশে কোম্পানিগুলো পোলট্রি খাদ্যের দাম কমাচ্ছে না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সব জানার পরও নীরব থাকায় সংকটের সমাধান হচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হলো, কয়েক মাসে সবকিছুর দাম যেভাবে বেড়েছে সাধারণ মানুষ এখন সবজি, ভর্তা বা ডিম দিয়ে খাওয়ার পরেও খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে, প্রান্তিক মানুষ তাহলে কী খেয়ে বাঁচবে? শেষ পর্যন্ত গরিবের আমিষের উৎস ডিমও কি মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে?
ব্যবসায়ীরাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বেপরোয়া। তারা সুযোগ খোঁজেন কখন দাম বাড়ানো যায়। এর জন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণও লাগে না। অন্যদিকে যারা কারসাজি করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই অন্যরাও এই ধরনের কারসাজি ও অনিয়মে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহিত হচ্ছে। যা সভ্য দেশের জন্য কোনো অংশেই ভালো নয়। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করা না হলে অস্থিরতা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়বে। তাই এখনই সময় এদের দমন করা।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।