জ্বালানির দাম নির্ধারণের নীতি জনস্বার্থবিরোধী

।। অধ্যাপক এম শামসুল আলম।।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সপ্তাহ ২০১৮ উদযাপন উপলক্ষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ৮ সেপ্টেম্বর এনার্জি প্রাইসিং শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে সভাপতি ছিলেন জ্বালানি সচিব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। নির্ধারিত আলোচক ছিলেন বিইআরসির সদস্যসহ চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা, বিপিসি, পিডিবি ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা। সেই সঙ্গে ছিলেন এআইটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর জয়শ্রী রায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দিতে চায় না। সেই বিবেচনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রাইসিং বা মূল্যহার নির্ধারণ নীতি/কৌশল কী হতে পারে, সেমিনারে সে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ক্যাবের বক্তব্যে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্ব পেয়েছে। ক্যাব বলেছে—

এ প্রাইসিং তথা মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নানা দেশে নানা পরিপ্রেক্ষিতে নানা নীতি বা কৌশল বিবেচনা করা হয়। আমাদের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় কী কী ভাবে বিবেচিত হওয়া দরকার, তা আজো স্পষ্ট হয়নি। ফলে ভোক্তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সেসব বিষয় নিয়ে কথা হতে হবে। তবে সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাব করা আছে। গ্যাসে এসডি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

জনগণের জ্বালানি অধিকার সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকার। সে অধিকার সুরক্ষায় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ও প্রতিযোগিতা আইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব আইনের আওতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভোক্তা বা জনগণের জ্বালানি অধিকার সুরক্ষা পায়। তাছাড়া সংবিধানের ১০২ ধারার আওতায় সুপ্রিম কোর্টও সে সুরক্ষা দেন। কিন্তু জ্বালানি খাত প্রশাসন স্বার্থসংঘাত ও দুর্নীতিমুক্ত না হওয়ায় সে অধিকার এখন বিপন্ন। যেকোনো সময়ের তুলনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন সরকারের কাছে অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। অথচ তা সরবরাহে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণহীন। তাই এ খাতে আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি অব্যাহত। মূল্য ও ভর্তুকি বৃদ্ধিতেও সে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কাটেনি। বিদ্যমান এনার্জি প্রাইসিং পলিসি মুনাফা ও সরকারের রাজস্ববান্ধব; ভোক্তাবান্ধব নয়। মুনাফা ও রাজস্ব আহরণ মার্জিন যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত না হলে প্রাইসিং যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অন্যান্য অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি যৌক্তিক করা হলেই কেবল এনার্জি প্রাইসিং যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত এবং ভোক্তা স্বার্থসম্মত হতে পারে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়—

(ক) জ্বালানি তেলে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে লিটারপ্রতি ১০ টাকা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। বছরে ৬০ লাখ টনেরও বেশি জ্বালানি তেল আমদানি হয়। এ প্রস্তাব মতে, ঘাটতি ৬ হাজার কোটি টাকারও অধিক। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছিল, তখন আমরা লিটারপ্রতি ডিজেল কিনেছি ৬৮ টাকায়। অকটেন-পেট্রল ১০০ টাকায়। ফার্নেস অয়েল ৬২ টাকায়। আমদানি ব্যয়হার হ্রাস আংশিক সমন্বয় হওয়ায় এখন কিনে থাকি ডিজেল ৬৫ টাকায়, ফার্নেস অয়েল ৪২ টাকায় আর অকটেন-পেট্রল ৯০ টাকায়। বর্তমানে ব্যারেলপ্রতি তেলের মূল্য কমবেশি ৭০ ডলার। প্রস্তাবিত ঘাটতি সমন্বয়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাইসাপেক্ষ। এটি ব্যতীত মূল্য নির্ধারণ হলে ভোক্তা অধিকার খর্ব হবে। এই একই কথা এলপিজি ও এলএনজির মূল্য নির্ধারণেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

(খ) বিদ্যুতের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধি হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে ভতুর্কি ধার্য করা হয় গণশুনানির ভিত্তিতে, প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ ওই অর্থবছরে সে ঘাটতি ৮ দশমিক ৬ হাজার কোটি টাকা। এমন ব্যয় বৃদ্ধি যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ নীতি ও কৌশল কতটা বিভ্রান্তির শিকার হলে এমন অন্যায় ও অযৌক্তিক ঘাটতি সৃষ্টি হয়, তা এ তথ্যে সহজেই বোঝা যায়। যৌক্তিক করা ছাড়াই ওই ঘাটতি ভর্তুকি/মূল্যবৃদ্ধি দ্বারা সমন্বয় হলে ভোক্তা অধিকার খর্ব হবে। এখানে বলা দরকার, অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধির উপাদানগুলো চিহ্নিত করে ক্যাবের হিসাবে দেখানো হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ সরবরাহে অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে উৎপাদনে ৮ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যয় বৃদ্ধি হ্রাসের কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগ কেউই আমলে নেয়নি। ফলে ক্যাব সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা করে। মামলাটি এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

(গ) সম্প্রতি এলএনজি মিশ্রিত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে। অচিরেই মূল্যবৃদ্ধির আদেশ হবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা গণশুনানিতে যাচাই-বাছাই হতে হয়। কেবল সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির  প্রস্তাব গণশুনানিতে যাচাই-বাছাই হয়েছে। শুনানিতে বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। বরং বিদ্যমান চার্জ হারে বছরে ৪৭১ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে বলে প্রমাণিত হয়। ২০১৫ সালের গণশুনানির ভিত্তিতে গ্যাস বিতরণ ব্যয় যৌক্তিক করা হয়। ফলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিতরণ ব্যয় সাশ্রয় হয় ১ হাজার ৫ কোটি টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যহার বিতরণ ইউটিলিটিভেদে সমতা রক্ষা করায় উদ্বৃত্ত থাকে ৯২৯ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা। এলএনজি মিশ্রিত গ্যাসের মূল্যহার ভারিত গড়ে ৭ দশমিক ৩৯ থেকে ১১ দশমিক ৯৫ টাকা প্রস্তাব করা হয়। এ ব্যয় বৃদ্ধির কেবল ৩ শতাংশ ব্যয় গণশুনানিতে যাচাই-বাছাইক্রমে ধার্য করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশ কতটা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত, তা যাচাই-বাছাই হয়নি। গণশুনানিতে ওই ৯৭ শতাংশ ব্যয় যৌক্তিক করা ব্যতীত মূল্যবৃদ্ধি অন্যায় ও অযৌক্তিক হবে। ভোক্তা অধিকার খর্ব হবে।

(ঘ) সরবারাহ ব্যয় যৌক্তিক করা ব্যতীত ক্যাবের হিসাবে এলএনজি মিশ্রিত গ্যাসে আর্থিক ঘাটতি প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। সে ব্যয় যৌক্তিক করা হলে মূল্যবৃদ্ধি বা ভর্তুকি ছাড়াই এ ঘাটতি সমন্বয় হতে পারে। এমন প্রস্তাব ক্যাব জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে এবং বিইআরসির কাছে পেশ করেছে। তাছাড়া সে প্রস্তাবে গ্যাস সরবরাহে নানা অযৌক্তিক ব্যয় যৌক্তিক করার লক্ষ্যে কিছু সংস্কার প্রস্তাবও রয়েছে। সেসব বিবেচনায় না নিয়ে মূল্যবৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক হবে না। ভোক্তা অধিকার খর্ব হবে।

(ঙ) গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল এবং সাপোর্ট ফর শর্ট ফল তহবিল গঠনের লক্ষ্য অর্জন এসব তহবিল ব্যবহার দ্বারা নিশ্চিত হয়নি। এসব তহবিল এখতিয়ারবহির্ভূত কর্তৃত্ব দ্বারা পরিচালিত এবং নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত। তাছাড়া ক্রয়চুক্তি বে-আইনিভাবে পরিবর্তন করে ব্যক্তিখাত বিদ্যুৎ ক্রয় করায় ভোক্তারা বছরে শত শত কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এসব অভিযোগ বিরোধ হিসেবে নিষ্পত্তির জন্য ক্যাব বিইআরসিতে আবেদন করেছে এবং মন্ত্রণালয়ের নজরে এনেছে। এসব অভিযোগের আইনানুগ নিষ্পত্তি ব্যতীত মূল্যবৃদ্ধি করা হয়, যা ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। তাতে ভোক্তা অধিকার খর্ব হয়।

(চ) মূল্যহার নির্ধারণে পাইকারি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ইউটিলিটিদের মধ্যে এবং খুচরা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের মধ্যে সমতা রক্ষার নীতি অনুসরণ করা হয়। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে যা হয় না। ফলে অবগ্রিড এলাকায় ভোক্তারা চরমভাবে মূল্যহার বৈষম্যের শিকার। সৌরবিদ্যুৎ মাসিক ১২০ টাকা সার্ভিস চার্জসহ ৩০ টাকা মূল্যহারে ভোক্তারা ব্যবহার করে। প্রান্তিক ভোক্তারা কোনো সুরক্ষা পায় না। অথচ প্রান্তিক আবাসিক (লাইফ লাইন) ভোক্তা মাসিক ২৫ টাকা ডিমান্ড চার্জসহ ইউটিলিটিভেদে ৩ দশমিক ৫০ থেকে ৩ দশমিক ৮০ টাকা মূল্যহারে গ্রিড বিদ্যুৎ পায়। গ্রিড ও অবগ্রিড বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ভোক্তার মূল্যহারে সমতা নিশ্চিত করা ব্যতীত মূল্য নির্ধারণ ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। তাতে ভোক্তা অধিকার খর্ব হয়েছে।

(ছ) দেখার বিষয়, মূল্যহার ১ পয়সা কম/বেশি হলে ভোক্তাদের বছরে কম/বেশি দিতে হয় বিদ্যুতে ৬০ কোটি টাকা। গ্যাসে ৩১ কোটি টাকা। ১ টাকা কম/বেশি হলে তেলে ৬০০ কোটি টাকা কম/বেশি দিতে হয়। এ তথ্যে বোঝা যায়, মূল্য নির্ধারণে অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’— এ সত্য স্থান-কাল ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যেমন অক্ষয় ও অব্যয়, আবার সঠিক দামে, মানে ও মাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা পেতে তার দাম, মান ও মাপ যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা ভোক্তার মৌলিক অধিকার— এ সত্যও তেমনি অক্ষয় ও অব্যয়। কোনো অজুহাতেই এ অধিকার থেকে ভোক্তাকে বঞ্চিত করা যায় না। তাই সে অধিকার সুরক্ষা ব্যতীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা অন্যায় ও অযৌক্তিক এবং ভোক্তা অধিকার খর্ব করার শামিল। আমরা এমন কাজ কোনোভাবেই করতে পারি না।

সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লা, জ্বালানি তেল, এলপিজি, এলএনজি ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়মূল্য এবং সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বিধিবদ্ধভাবে ভোক্তাকে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ দিন। সঠিক দামে, মানে ও মাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা পেতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করুন। তাতেই কেবল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন সম্ভব, অন্য কোনো কিছুতে নয়।

 

লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)