এস এম নাজের হোসাইন: ডেঙ্গু এখন করোনা মহামারির চেয়ে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে নতুন করে করোনার চিকিৎসার সময়ের সেই অমানবিক ও বর্বর কাহিনির আবার আর্বিভাব ঘটছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা থাকলেও তা যথোপযুক্ত নয়।
সরেজমিন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডাকলেও আসেন না চিকিৎসক, খারাপ ব্যবহার নার্সদের! রোগী বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, এটা বলার পরও তার বিছানার কাছে চিকিৎসক কিংবা নার্স কেউ আসেননি। তাদের ডাকলেই বলেন, এখান থেকে যান; এখন আসব, তখন আসব… (ঢাকা পোস্ট, ১৯ জুলাই ২০২৩)
উপজেলা হাসপাতাল থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো রোগী পাঠালে তার জন্য নতুন করে সবগুলো পরীক্ষা নতুন করে করতে হয়। না হলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। আর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইন ও সময় নিতে হয়, যা ডেঙ্গু রোগীর পক্ষে দেওয়া কঠিন।
কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি হাসপাতালগুলোর। সংকটময় পরিস্থিতিতে অনেকে নিরুপায় হয়ে ছোটেন বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু রোগীকে নিরুপায় মনে হলেই বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে মুনাফার লোভ বেড়ে যায়। তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের রীতিমতো জিম্মি করে ‘গলা কাটা’ ফি আদায় করে।
করোনার পর এবার ডেঙ্গুর চিকিৎসায়ও দেশে একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পর্যাপ্ত তদারকি না থাকার কারণেই মূলত স্বাস্থ্য খাতে এমন নৈরাজ্য চলছে। সরকারি কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় একজন রোগী পাঁচ হাজার টাকায় যে সেবা পান, তা বেসরকারি হাসপাতালে পেতে গুনতে হয় ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা।
সরকারি হাসপাতালে ‘অ্যাপারেসিস প্লাটিলেট’ (রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করার প্রক্রিয়া) করতে খরচ পড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে শয্যা ভাড়া, ২৪ ঘণ্টায় কয়েকবার চিকিৎসক রাউন্ড দেন, পাশাপাশি মেডিসিন ও অন্যান্য চার্জসহ লাগে বিপুল অর্থ। খরচ বেশি আইসিইউ ব্যবহারেও; সাধারণ মানের বেসরকারি ক্লিনিকে একদিনেই গুনতে হয় ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেকে আবার কতগুলো রোগীর পেছনে একই পরীক্ষা একাধিকবার করাচ্ছেন, অক্সিজেন সাপোর্ট ও মনিটরিংয়ে ঘণ্টা হিসাবে চার্জ নিচ্ছে। ফলে খরচ অনেক বেশি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু শুধু ঢাকায় নয় বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি বড় শহরগুলোয় হানা দিয়েছে। তবে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এর সংক্রমণ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। তবে আগস্ট আসার আগেই জুলাই মাসে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তাতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের কী ভয়ংকর পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
গণমাধ্যমেও ডেঙ্গু সম্পর্কিত খবরাখবর বেড়েছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে ডেঙ্গু উত্তাপ আসলে কত বেড়েছে। এখন ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রচার করা হচ্ছে, যেটা করোনার সময়ও দেখা গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা তাদের শিশু-কিশোরদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতেও সাহস পাচ্ছেন না।
ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর হার বেড়েছে। শিশুদের মৃত্যু সাধারণ মানুষকে আরও ভয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেকেই ডেঙ্গুতে শিশু মৃত্যুর কথা লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করেছেন। চেষ্টা করেও সেই ছবি থেকে চোখ ফেরানো কঠিন হচ্ছে। যে মাতাপিতা সন্তান হারিয়েছেন তার মনোবেদনা বা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কি কারও আছে?
একজন সন্তানকে বাবা-মা কত আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে জন্ম দেন, কত ভালোবাসায় বড় করেন! আর সেই সন্তান যদি ডেঙ্গুতে মারা যায়, বুকটা কেমন হাহাকার করে! অথচ প্রতিবছরই একই ঘটনা ঘটছে। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডগুলোয় চলছে বাবা-মায়ের আকুতি- ‘রক্ত লাগবে’। এর শেষ কোথায়? স্বজনহারাদের আহাজারি থামবে কবে এই দেশে?
করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাত কতটা অথর্ব ও জবাদিহিতাহীন। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতেও সেই পথে হাঁটা শুরু করেছে। অনেক জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, সরকারের সঠিক তদারকি না থাকায় স্বাস্থ্য খাতে এমন নৈরাজ্য চলছে। বেসরকারি চিকিৎসা খাতে লুণ্ঠন ও চিকিৎসা খরচ বেশি, কিন্তু তাই বলে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় আট-দশগুণ হতে পারে না। রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসা সেবা পুঁজি করে টাকা কামানোর মেশিন বানিয়ে ফেলা সঠিক হয়নি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বেসরকারি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ চিকিৎসায় অবহেলা, অনিয়ম সম্পর্কে সতর্কবাণীর পরিবর্তে সত্যিকারের মনিটরিং ও নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নাগরিক নজরদারি নিশ্চিত করতে পারলেই এই চিকিৎসা সেবার দুর্বিষহ অবস্থার অবসান হবে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।