গোলাম রহমান: আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, গত বছর মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯.০২ শতাংশ, যা বিগত এক যুগে সর্বোচ্চ। অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করেছেন। সম্ভবত তার একটা বড় অংশ আসবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাঁকশাল থেকে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দেবে। করোনা মহামারির সময় ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব দেশেই ভোক্তাদের নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়। জ্বালানি তেলের দাম ও পণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়ে। সারা পৃথিবীতে মুদ্রাস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তা আরও উসকে দেয়। এই পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি করে চাহিদার লাগাম টানতে উদ্যোগী হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরবরাহ পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে।
দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি এখন নিম্নমুখী। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসছে। কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসৃত নীতি বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয় বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এতে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ পাঁচ গুণ বেড়েছে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী অর্থ সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধির ফলে টাকায় আমদানি করা পণ্যের মূল্য বহুলাংশে বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে টাকার অঙ্কে কর-ভ্যাটও বাড়ছে। ফলে পণ্যমূল্য বাড়ছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দরপতনের সুফল থেকে বাংলাদেশের ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির আঁচ সহনীয় করার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী করারোপযোগ্য আয়ের সীমা কিছুটা বৃদ্ধি করেছেন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, সময়ই বলে দেবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানাকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রণয়ন হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল। এতে বাজেটের আকার ও ঘাটতির পরিমাণ কম হতো। অন্যদিকে নির্বাচনের বছর উন্নয়নের পথে ধীরগতি, রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট প্রণয়ন করেছেন। প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। সাধারণত পরিস্থিতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্পষ্ট করেছেন, ‘নয়-ছয়’ সুদের হার নির্ধারণ এবং তা কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এতে ‘সুদের হার’ বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। সরকার যদি মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে চায়, তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘সুদের হার’ নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের বিকল্প নেই। সরকারের ব্যবসাবান্ধব ‘সুদনীতি’ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন সহায়ক হবে বলে মনে হয় না। আর বিপুল অঙ্কের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হলে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাবে বলে মনে হয় না।
বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যের দাম একেবারে আকাশছোঁয়া। তেলের দাম বেড়েছে। চিনির দাম সরকার ঠিক করে দিলেও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে না। আমদানির কোনো প্রভাব পড়েনি পেঁয়াজের দামে। মাছ-মাংসের দাম অনেক বেশি। গরিবের পুষ্টি ডিমও এখন গরিবের আয়ত্তের বাইরে। আপাতদৃষ্টিতে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি নেই। তা সত্ত্বেও দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। বেশির ভাগ পণ্যের মূল্য এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে আর ধারকর্জ করে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছে। অনেক চাহিদাই পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্থির আয়ের জনসাধারণের জীবনমানে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভোক্তাস্বার্থ দেখার জন্য বিলম্বে হলেও ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার আইন, ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইনসহ আরও কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
অনেকের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে বাজারে। বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের মূল্যই ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় নিজ নিজ দেশের ভোক্তাদের বিদেশ থেকে আক্রান্ত মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষার জন্য মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার ‘সুদের হার’ বৃদ্ধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দেশে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে দেখানো অযৌক্তিক।
বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধি ও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। গুটিকয়েক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও কাটেলের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি সরকারকে খাদ্য বিভাগ, টিসিবির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ ও বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানায় এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে বাজার মনিটরিং জোরদার করা উচিত।
মূল্য পরিস্থিতি একদিনে বর্তমান পর্যায়ে আসেনি। কাজেই তাৎক্ষণিক ভাবে নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই, তবে তা পর্যাপ্ত না-ও হতে পারে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় এনে বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি; জ্বালানি, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানোন্নয়ন বাজার পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে আনতে সহায়ক হবে। সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি এবং জীবনমানের উৎকর্ষসাধন জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি আনতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখবে। বাজারের লাগামহীন মূল্যস্ফীতি তাতে কিছুটা হলেও সহনীয় হবে।
লেখক: সভাপতি, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, খবরের কাগজ।