এস এম নাজের হোসাইন: দেশে একটা সময় ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে খাদ্য সংকট হতো। প্রান্তিক আয়ের মানুষগুলো এই সময় কীভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। এবার ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) প্রতিবেদনে জানায় মার্চ ও এপ্রিলে প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে।
আর মে থেকে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই হার আরও ৭ শতাংশ বাড়বে। এমনিতেই দেশে করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
বিবিএসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিগত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে তা দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। এই সময়ে বেড়েছে খাদ্যমূল্যস্ফীতিও। আর এর প্রভাব পড়ছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায়। আবার জলবায়ুর বিরূপ আচরণ ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে এই অভিঘাত আরও বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসাব মতে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুনে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে যেমন খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে গ্রাম ও শহর সর্বত্রই।
চাল, ডাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গ্রামে জুনে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
আইপিসি দেশের ১৫ জেলার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ অনুযায়ী মার্চ ও এপ্রিলে এই জেলাগুলোর প্রায় ৮৯ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। এর মধ্যে ৭৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৪৯ জন মানুষ খাদ্যের জন্য সঞ্চয় ভেঙেছে বা বিভিন্ন সংকটে ছিল, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ। আর ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৫ জনের বা ৩ শতাংশের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন হয়েছিল।
এছাড়া এক কোটি ৩৫ লাখ বা ৩৫ শতাংশ মানুষ খাদ্যমূল্য নিয়ে চাপে ছিল। মোট ৪১ শতাংশ বা এক কোটি ৫৭ লাখ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা স্বাভাবিক ছিল। তবে সংস্থার মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে দেওয়া পূর্বাভাসে মানুষের মধ্যে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা অর্থাৎ সংকটে থাকা ও জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন হবে এমন মানুষের হার প্রায় ৭ শতাংশ বেড়ে ৩১ শতাংশ হবে। এর মধ্যে জরুরি সহায়তার প্রয়োজন এমন মানুষের হার ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬ শতাংশ হবে।
খাদ্য নিয়ে সংকটে থাকা মানুষের হার ২১ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ হবে। চাপে থাকা মানুষের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশ হবে। আর খাদ্য নিরাপত্তা স্বাভাবিক থাকবে ৩৫ শতাংশ মানুষের, যা বর্তমান অবস্থা থেকে ৬ শতাংশ কমবে।
আইপিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বেশি ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ৪৫ শতাংশ মানুষ, যারা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। যার মধ্যে ৩৫ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিয়ে সংকটে ছিল এবং ১০ শতাংশ মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন ছিল।
খাদ্য নিয়ে চাপে ছিল আরও ৩৫ শতাংশ মানুষ। আবার মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জেলার ৫০ শতাংশ মানুষ তখন তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
দেশের অন্যতম দরিদ্রপ্রবণ জেলা কুড়িগ্রামে মার্চ ও এপ্রিলে ৩৫ শতাংশ মানুষ তৃতীয় স্তরের ওপরে অর্থাৎ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। মে থেকে সেপ্টেম্বরে এই হার দাঁড়াবে ৪০ শতাংশে। সাতক্ষীরা জেলায় তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ৩০ থেকে ৫ শতাংশ বেড়ে ৩৫ শতাংশ হবে। জামালপুর জেলায় এই হার ৩০ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে ৪০ শতাংশ হবে।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার মূল কারণ হিসেবে খাদ্যপণ্যের দামবৃদ্ধি বলা হলেও এই নিত্যপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে উল্টো চিত্র। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরের ব্যবধানে চিনি ছাড়া প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমেছে গড়ে ২১ শতাংশ। এর প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হারও কমতে শুরু করেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম গড়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেড়েছে। ওই সময়ের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ গ্যাস ও কয়লার দামও কমেছে।
একই সঙ্গে কমেছে পণ্যপরিবহনের জাহাজ ভাড়া। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় স্বাভাবিকভাবে কমার কথা। দেশে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ কিছুটা বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া কমেছে, এর কোনো প্রভাব দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে পড়েনি।
বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোও তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। তারা তদারকি করলেও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে দেশের বাজারের দামের সমন্বয় করতে পারছে না।
ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ালেও এতে নতুন করে যোগ হয়েছে চড়া দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি এবং দেশে মূল্যসংযোজন কর, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দামসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য ও ফি বাড়ানোয় উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
যে কারণে দাম কমানো যাচ্ছে না, যে কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির হার কমছে না। উল্টো খাদ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে এক বছরের ব্যবধানে গড়ে পণ্যের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
বিবিএস প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যের সূচক কমলেও খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তবে বাজার ও ভোক্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমার প্রভাব দেশে পড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব। কেননা এক্ষেত্রে উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাত-সব ক্ষেত্রেই রয়েছে অব্যবস্থাপনা। সেটি না হলে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় যেমন—বোরো ধান, ভরা মৌসুমের সময়ও দেখা যায় আগের মতো আর চালের দামটা কমে না।
দেশে বাম্পার উৎপাদন হলেও এ ক্ষেত্রে উৎপাদন দিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না। এখানে মূল সমস্যা হলো বাজারে যেসব খেলোয়াড় খেলছে, তাদের কারসাজি। তেমনই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে এর প্রভাব দেশের বাজারে না পড়ার ক্ষেত্রেও একই কারণ দায়ী। কীভাবে কারা এসব খেলা খেলছে, এটা কি কর্তৃপক্ষ জানে না?
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, যারা কারসাজি করছেন তাদের আমরা চিনি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিছু করলে অস্থিরতা বাড়বে। কিন্তু ওই রাঘববোয়ালদের জেলে দেওয়া হচ্ছে না। যারা কারসাজি করে, তাদের জন্য যেসব নীতি সহায়তা বা ভর্তুকি ও আমদানি শুল্ক সুবিধা আছে, সেইগুলো বাতিল করে দিতে পারে।
সেইদিকে না গিয়ে সরকার যদি এভাবে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে, তাহলে বর্তমান বাজারের খেলোয়াড়রা তো অবৈধ সুযোগ নেবেই। সেই সঙ্গে নতুন নতুন খেলোয়াড়রাও উৎসাহিত হবেন। এটা একসময় ছোঁয়াচে রোগের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।
আমরা বার বার বলেছি, নানা কারণে ২০২২ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ আরও বেশি সংকটে আছে। নিত্যপণ্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। অন্যদিকে মানুষের আয় বাড়ছে না। এছাড়া বৈশ্বিকভাবেই খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার পূর্বাভাসও রয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালের দাম বাড়ছে।
দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমস্যাও প্রকট হচ্ছে। যার পরিণতিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়তে পারে। তাই সরকারিভাবে বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিতভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিগুলো দ্রুত দূর করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম বাড়িয়ে এই সংকট দূর করতে হবে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।