মোস্তফা হোসেইন: রোজা আসছে- আতঙ্ক বাড়ছে মধ্যবিত্তের। বরাবরের মতোই কি রোজায় তাদের প্রাণান্ত লড়াই চলবে-দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে? বিশেষ করে তেল, চিনি, সবজির মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়ার উদাহরণ নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর এবার তো রমজানের বহু আগেই বেশ কিছু পণ্যের মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার বাইরেই আছে। সবজির মৌসুমে বাজার দর কিছুটা স্থিতিশীল থাকার পরও অযৌক্তিক ভাবে পেঁয়াজ সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।
নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এই উচ্চমূল্যকে মন্ত্রণালয়ের উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন। তার সৌভাগ্য, তিনি চেয়ারে বসাকালে শুরু হয়েছে সবজির মৌসুম। তরকারি বাজারের হা হুতাসের ভাগ তাকে তেমন একটা পেতে হচ্ছে না। কিন্তু রোজা আসছে, নিন্ম ও মধ্যবিত্তের জীবনে আতঙ্ক হিসেবে। আর সেই সময় যদি বাজারে আগের মতো আগুন ছড়ায়, তাহলে এই মুহূর্তে মানুষ নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করছেন তার বিপরীতটাই হয়ে পড়বে।
আশার কথা, বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। পেশাগত কারণে প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের আন্তরিকতা,পরিশ্রমী ও গতিশীলতা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি নিজে একজন ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে ব্যবসায়ের ফাঁকফোকরগুলো জানেন অন্যদের তুলনায় বেশি। সেই সুবাদেই তিনি বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন হয়তো।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে বাজার। যার কুফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা শুধু বাজারের ক্ষতি করে এটাও নয়, বাজার ব্যবস্থাপনা এমনই ধাঁচে তৈরি যেখানে তাদের অনুপস্থিতিতে পণ্য বিপণন স্থবিরও হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কর্তৃত্বকে বাতিল করার মতো সক্ষমতা আছে বলে মনে করি না।
এর একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আগে কোনো একটি লেখাতেও বিষয়টি আমি উল্লেখ করেছি। বলেছি উৎপাদন আশানুরুপ হওয়ার পরও কিভাবে উৎপাদনকারীর কপাল পোড়ে এবং ভোক্তাও তার সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। বছর দুই আগে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা গ্রামে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মীরা কৃষকদের কচুর লতি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন।
সেই অনুযায়ী তিন জন চাষি কুমিল্লা কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে চারা সংগ্রহ করেন। স্থানীয় কৃষিকর্মীদের তত্ত্বাবধানে তিনজনই বিশাল সাফল্য অর্জন করেন কচুর লতি চাষে। ওই এলাকায় কচুর লতি চাষ এর আগে কখনো হয়নি। কিন্তু বাম্পার ফলন হলেও তাদের ভাগ্যের বিপর্যয় হয় আরও বাম্পার। চান্দলা সরকার বাড়ির মোস্তফা সারওয়ার ওই সময়ই আমাকে জানিয়েছিলেন, একজন শ্রমিক এক কর্মদিবসে তার জমি থেকে ১ মণ (৪০ কেজি) লতি কাটতে পারে। শ্রমিকের মজুরী ৬০০টাকা, লতি বাজারে নিতে ভ্যানভাড়া ১০০টাকা তাৎক্ষণিক ব্যয়।কিন্তু বাজারে লতি বিক্রি করলেন ১০টাকা কেজি।
হিসাবটা দাঁড়ালো এক মণ লতিতে শুধু বিক্রয়কালীন ব্যয় ধরলেই ৩০০টাকা ক্ষতি। অন্যান্য উৎপাদন ব্যয়তো হিসাবের বাইরেই থেকে গেছে। এর কারণ স্থানীয় বাজারে একদিনে ১মণ লতি বিক্রি হওয়ার মতো ক্রেতা ছিলো না। আশেপাশে বাজারগুলোতে সর্বোচ্চ ১৫টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি করে শেষ পর্যন্ত জমি থেকে লতি কেটে সেগুলো ডোবায় স্তুপ দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন তিনি। অথচ ওই সময় ঢাকার বাজারে লতির কেজি ৬০ টাকা। যদি ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগীরা সেখানে থাকতো তাহলে হয়তো এতটা লোকসান গুণতে হতো না লতি চাষিদের।
ওই সময় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি কৃষি পণ্য বিপণন অধিদফতরের কোনো অফিস উপজেলায় নেই। জেলাতেও নাকি ২/৩জন কর্মচারীর একটি অফিস আছে। উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য-চান্দলা গ্রামের ওই তিন চাষি উৎপাদনে সাফল্য লাভের পরও যে লোকসানের শিকার হয়েছেন যদি বিপণন ব্যবস্থা সুষ্ঠু থাকতো তাহলে তারা পরবর্তীকালে লতি চাষ করতেন। অধিক কৃষি উৎপাদন তখনই বাজারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, যখন সেখানে সুষ্ঠু কৃষি ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী থাকে।
তাই বাজার ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ এলে কৃষি ব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। এখন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী যদি মনে করেন, এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়, তাহলে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের নিত্যপণ্য তালিকায় সর্বাধিক স্থান দখল করে রেখেছে কৃষিজ পণ্য। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয় অতি জরুরি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগকে কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। অতি মুনাফা লোভীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজার মনিটরিং গতিশীল করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থাকে চাঁদামুক্ত রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মহলের সমন্বয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাকে অবশ্যই জনপ্রতিনিধির ভূমিকা পালন করতে হবে। যা তার কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশাও তেমনটাই।
চাঁদাবাজির সঙ্গে শাসক দলের নাম জড়িয়ে পড়ে সবসময়। দলীয় ভাবে তা অস্বীকার করা হলেও দোষটা দলের ওপর পড়ে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে তাই বাদ দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের কোন কোন জায়গায় চাঁদাবাজি হয় তা প্রশাসনের অজানা নয়। কারা জড়িত তাও অজানা নয়। তাই শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে কিংবা ব্যবসাস্থল মনিটরিং করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। চাঁদাবাজিমুক্ত বাজার ব্যবস্থার জন্য তাই রাজনৈতিক শক্তিরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। গত মেয়াদে সবচেয়ে সমালোচিত হয়েছে এই দ্রব্যমূল্য। মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে দ্রব্যমূল্য হওয়ার কারণে মানুষ ছিলো অত্যন্ত বিরক্ত। এই মনোভাবকে পরিবর্তন করতে হলে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করতে সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। আর এই কঠিন কাজটির সিংহভাগ দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কৃষি, শিল্প, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সমন্বয় মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান হতে পারে।
এই মুহূর্তে দেশের উন্নয়নে মানুষ যতটা খুশি তার চেয়ে বেশি অখুশি দ্রব্যমূল্য তাদের আয়ত্বের বাইরে থাকায়। উন্নয়নের সুফল আনতে হলে মানুষের আস্থা অর্জনে সফল হতে হবে। সবার আশা উন্নয়নে সফল এই সরকার মানুষকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেবে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।