ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: আইনে নতুন সংযোজনীর ফলে এখন সরকার চাইলেই যখন ইচ্ছা তখনই, কোনো রকম গণশুনানি ছাড়াই যেকোনো জ্বালানি বা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে।
আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে নানা রকম দায়মুক্তির আইন রচনার ইতিহাস আছে। আবার সময়ে সময়ে আদালতে সেসব বাতিলেরও নজিরও আছে। খোদ দেশের স্থপতি, জাতির জনককে হত্যার মতো বীভৎস ও পৈশাচিক অপরাধের বিচার বন্ধ করার জন্য দায়মুক্তির আইনও রচিত হয়েছে এ দেশেই। আবার একসময় আদালতে তা বাতিলও হয়েছে।
আমাদের আইনের ইতিহাস ঘাঁটলে দায়মুক্তির আইন রচনা ও বাতিলের ঘটনাক্রম, কারণ ও পরিণতি সম্পর্কে একটা ধারণা মিলবে সবারই। আজকে সেই ইতিহাসের দিকে যাব না। দৃষ্টি নিবন্ধ করব বহুল আলোচিত একটি কথিত দায়মুক্তির আইনের দিকে। আইন-শৃঙ্খলা, জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রয়োজনে নয়, শুধুমাত্র দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের নামে তৈরি হয়েছে এরকম একটি দায়মুক্তির আইন। যার নাম, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’ যেটা ২০১০ সালের ৫৪ নং আইন হিসাবে চিহ্নিত। এই আইনের মেয়াদ ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংশোধনীতে এই আইনকে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’ নামে অভিহিত করা হয়। যা ২০২১ সনের ২২ নং আইন নামে পরিচিত। এই আইনের মেয়াদ ১৬ বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। সরকার তার নিজ ক্ষমতাবলে এই আইনের মেয়াদ বাড়িয়েছে।
কেন, এই আইন
সরকারি ভাষায় বলা হচ্ছে, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণনের জন্য দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে এবং প্রয়োজনে, বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি করার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি সম্পর্কিত খনিজ পদার্থের দ্রুত আহরণ ও ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের জন্যই অনুসরণীয় বিশেষ বিধান প্রণয়নকল্পে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
অর্থাৎ সরকার দ্রুত মানুষকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করতে চায়। তাই যারপরনাই দ্রুত ব্যবস্থার মাধ্যমে পথের বাধাগুলো সরাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন সরকারকে বানাতে হয়েছে।
সরকারের বিশেষ যুক্তি
যেহেতু দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি চরমভাবে বিরাজ করছে; জ্বালানির সরবরাহের স্বল্পতা আছে তাই, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিজনিত কারণে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালী কাজকর্ম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একারণে এসব খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না।
বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততার জন্য উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নতুন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, প্রযুক্তির বিকাশ, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। জনজীবনে অস্বস্তি বিরাজ করছে।
অন্যদিকে, প্রচলিত আইনের অধীন প্রতিপালনীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা নিরসন সময় সাপেক্ষ। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা দ্রুত নিরসন করা একান্তই অপরিহার্য; সে কারণেই এই বিশেষ আইন সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।
এই বিশেষ আইন বানাতে এই হচ্ছে সরকারের যুক্তি।
আইনে যা আছে
আইনের ৬ (২) উপধারায় বলা আছে, উপ-ধারা (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর সম্মতি গ্রহণক্রমে যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ধারা ৫ এ বর্ণিত প্রক্রিয়াকরণ কমিটি সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে উক্ত কাজের জন্য মনোনীত করে ধারা ৭ এ বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার বা দরপ্রস্তাবের বাইরে গিয়ে, সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে কাজ প্রদান করা যাবে।
আইনের ৯ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
সংকট কোথায়
এই আইন বিশেষ প্রয়োজনে, বিশেষ সংকট মোকাবিলার জন্য ২০১০ সালে তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিশেষ সংকট কাটেনি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ সন্তোষজনক হয় নাই। লোডশেডিং কমে নাই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বারে বারে বেড়েছে। শুধু বাড়েই নাই, দাম বাড়ানোর স্বীকৃত পদ্ধতিগুলোর অবসান ঘটেছে। এই আইনের মেয়াদ বারে বারে বেড়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। এই আইনের ফলে:
১. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে টেন্ডার বা দরপত্র ছাড়াই ইচ্ছেমত দরে বা দামে, পছন্দসই যে কাউকে কাজ দেবার বা চুক্তি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
২. এই আইনি কাঠামো বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্বমূলক, অন্যায্য-অস্বচ্ছ-লুণ্ঠনমূলক- জবাবদিহিহীন চুক্তি বা কাজ করার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি হয়েছে।
৩. অন্যদিকে এই আইনের বলেই এসব অন্যায্য-অস্বচ্ছ কাজের জন্য আইনি প্রতিকারের সকল রকম পথ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ভূলুণ্ঠিত ভোক্তার অধিকার
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ১৩ নং আইন) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি বা বার্ক) নামের প্রতিষ্ঠানে। এটি সরকারের একটি রেগুলেটরি বডি। এই প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য আইনিভাবে স্বীকৃত। এর অন্যতম কাজ হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা।
এখানে জ্বালানি বা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দাবি পেশ করে। পরে সেই দাম কেন বাড়ানো হবে সে বিষয়ে প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যুক্তি পেশ করতে হয়। সবার উপস্থিতিতে প্রকাশ্য গণশুনানি হয়। সেখানে ভোক্তাদের পক্ষে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যে কেউই যোগ দিতে পারে। এবং সকল বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে। সরকার সম্প্রতি সেই আইনেও পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এ ৩৪ক ধারা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। সেখানে ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ বা সমন্বয়ে সরকারের ক্ষমতা বিষয়ে বলা হয়েছে- এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে, জনস্বার্থে, কৃষি, শিল্প, সার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালী কাজের চাহিদা অনুযায়ী এনার্জির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণনের নিমিত্ত দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, মজুদকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ বা সমন্বয় করিতে পারবে।
আইনে এই নতুন সংযোজনীর ফলে এখন সরকার চাইলেই যখন ইচ্ছা তখনই, কোনোরকম গণশুনানি ছাড়াই যেকোনো জ্বালানি বা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে।
দায়মুক্তির দায় এবং…
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের এইসব দায়মুক্তির আইন তৈরি ও তার সফল প্রয়োগের ফলেই স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্বমূলক, অন্যায্য-অস্বচ্ছ-লুণ্ঠনমূলক-জবাবদিহিহীন চুক্তি বা কাজ করার যে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি হয়েছে একদিকে যেমন তার আইনি প্রতিকারের পথ বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে, গণশুনানি বন্ধের মাধ্যমে ভোক্তার পক্ষে কোনো প্রশ্ন করারও সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।
ফলে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বাড়ছে তার মধ্যে কতটা স্বচ্ছ, কতটা অস্বচ্ছ, কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেই প্রশ্ন থাকছে। কিংবা ভোক্তাপক্ষে সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকছে না। দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ বিষয়ে ভোক্তার প্রশ্নের জবাব দেবার দায়ও থাকছে না।
১৬ বছর মেয়াদি এই দায়মুক্তির আইন বলবৎ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানোর যে নীতিগত পরিকল্পনা ছিল তার কোনটাই কাজে লাগছে না।
মিশ্র জ্বালানি কিংবা সাশ্রয়ী জ্বালানি অথবা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কম মূল্যের জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তাও কাজে লাগে নাই।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবির তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উপাদন করতে খরচ হতো ৬.০১ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা হয়েছে ১১.৩৩ টাকা। পাঁচ বছরেই প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে ৮৮.৫%।
এই সময়ে দেশের বাহির থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আমাদের খরচ হয় ১১.৩৩ টাকা। অথচ এই সময়ে ভারত থেকে আমদানিকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়েছে ৮.৭৭ টাকা। অর্থাৎ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার চাইতে আমদানি করা বিদ্যুৎ সস্তা পড়েছে। ফলে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত আমদানির বাজারে পরিণত হবার দিকে যৌক্তিকভাবেই এগিয়ে চলেছে।
দায়মুক্তি আইনের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎকে ক্রমশ ব্যয়বহুল করে তোলা হয়েছে। এই খাতে স্বেচ্ছাচারিতা-অদক্ষতা-অযোগ্যতা-দুর্নীতি-জবাবদিহিহীনতার মধ্য দিয়ে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা বাড়িয়ে ভোক্তার সর্বনাশ করা হচ্ছে। দেশের বাজারকে আমদানি নির্ভরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ভোক্তার অধিকারকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে অধিকতর ব্যয়ের মুখে ঠেলে দুর্বল করে প্রতিযোগিতায় অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি যা বহুলাংশে দেশের অর্থনীতি ও জীবনমানকে নিয়ন্ত্রণ করে- সেখানে নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক প্রভাব পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দায়মুক্তির দায় জনগণ বহন করবে কেন?
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, প্রকৌশলী।
ডেইলি স্টার বাংলা।