।। আনিস রায়হান ।।
দেশজুড়ে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এবারে এই দুই পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩১ জন। পরীক্ষার প্রথম দিন ১৮ নভেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ১৬৮ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দৈনিক প্রতিবেদনে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, জীবনের প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার এমন আশঙ্কাজনক কেন?
জানা যায়, অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৫৩ জন ও ইবতেদায়ি সমাপনীতে ৪২ হাজার ৪১৫ জন। প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা। ৭ হাজার ৪১০টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১২টি কেন্দ্র বিদেশে অবস্থিত। এবারের পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) বাদ দেওয়া হয়েছে। ছয়টি বিষয়ের প্রতিটিতে ১০০ নম্বর করে মোট ৬০০ নম্বরের পরীক্ষা হচ্ছে।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) নিয়ে শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও সচেতন মহলের নানা প্রশ্ন আছে। অনেকেই মনে করেন, পিএসসি পরীক্ষার জন্য ছোট্ট একটি শিশুকে অনেক পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিতে হয়। এটা শিশু মানসের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। শিশুকে এত অল্প বয়সে এত বড় প্রতিযোগিতার মঞ্চে ছেড়ে দিলে তার মানসিক বিকাশ সংকতের মধেয় পড়ে। একদিকে তার অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যায়। এটি কেবল ছোট্ট শিশুটির জন্যই ভীতিকর নয়, অভিভাবকদের তো বটেই, গোটা সমাজের জন্যও উদ্বেগের। অভিভাবক মহল ও শিক্ষাবিদদের অনেকেই তাই পিএসসি পরীক্ষা বাতিল করার আহবান জানিয়ে আসছেন। এ নিয়ে এমনকি রাজপথে মানববন্ধন, সেমিনারও হয়েছে।
পিএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির সঙ্গে শিশুদের পরীক্ষায় অনীহার সম্পর্ক থাকতে পারে। তাছাড়া এবার প্রশ্ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এটাও অনেক শিক্ষার্থীর প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ভীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ‘বছরের শুরুতেই এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বুঝে-শুনে, চিন্তাভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের পিএসসি এবং জেএসসি নামক দুটি সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। এটা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। প্রথম দিনের পরীক্ষা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ শেষে গণশিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি যখন বাস্তবায়ন হবে, তখন একটি পরীক্ষা হবে, নাকি দুটি হবে-সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে মন্ত্রিসভা যদি সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে এখনও একটি পরীক্ষা হতে পারে। কারণ, এই পরীক্ষাগুলো মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের আলোকেই হয়।’
মন্ত্রীর বক্তব্যে পরিষ্কার, নিজের কর্তব্যটুকু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তে এমন একটি বিতর্কিত পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছে হলো তো এমসিকিউ পদ্ধতি চালু করা হল, আবার ইচ্ছা হলে বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু কেন এমসিকিউ চালু হয়েছিল, আর কেনই বা তা বন্ধ করা হলো, এ বিষয়ে কার কোন গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ বা অনুসন্ধান নেই। ইচ্ছে খুশিমতো শিশুদের ওপর নিয়ম চাপানো হচ্ছে। এসবের ফলাফল শিশু মানসে কী হতে পারে, তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। মন্ত্রী তো মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেন। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার তিনিই যে অভিভাবক, এখানে যা করার সেটা যে তাকেই করতে হবে, তার বক্তব্যে এই দায়িত্বের ছাপ নেই!
অভিভাবক মহল, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে, শিশুদের রক্ষা করতে হবে। খেয়াল খুশির শিক্ষানীতি চলতে পারে না। শিশুদের ওপর কোনো নিয়ম চাপানোর আগে সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ। সব মহলের মতামত নেয়াও প্রয়োজন। শিশুদের রক্ষা না করা গেলে জাতির ভবিষ্যৎ সংকটে পোড়ে যাবে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, এই সত্য তাদের সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই মোতাবেক প্রাথমিক শিক্ষাকাঠামো সংস্কারে দ্রুত মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : সংবাদকর্মী