ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনার কারণেই বার বার জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ অর্থনীতির বড় ক্ষতি করেছে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জ্বালানি এমন একটি খাত যার প্রভাব সব কিছুর ওপরই পড়ে। ছোট-বড় সব শিল্পই জ্বালানির ওপর নির্ভর করে। এমনকি অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধেরও সম্পর্ক রয়েছে জ্বালানির দামে। অনেক কারখানা মাসে কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়। ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এখন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়।
জ্বালানির অতিরিক্ত টাকা তো উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। বাজার পরিস্থিতি মানুষের এমনিতেই নাগালের বাইরে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। মূল্যস্ফীতি দশের ঘর ছাড়িয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ হবে।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে আসল সুবিধা পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। নানা পক্ষ এখানে জড়িত। জরুরিভিত্তিতে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল প্ল্যান্ট করা হলো। এখন এগুলোর অনেকগুলো বন্ধ রয়েছে। চালু থাকলেও জ্বালানি অপচয় হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এগুলো তো সবাই জানে। গোপন রাখার বিষয় নয়। অদক্ষ-অব্যবস্থাপনা জ্বালানি খাতের মূল সমস্যা।’
রেন্টাল-কুইকরেন্টাল সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘সরকার সব জানার পরেও কিছু ব্যক্তিকে জ্বালানি খাতের মাধ্যমে সহজে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। এতে দেশের কোনো লাভ হয়নি। সার্বিক ভাবে ব্যবসার তথা সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসনি। বরং রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ অর্থনীতির বড় ক্ষতি করেছে। ত্বরিত সমাধান সব ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনে না। মিয়ানমারের মতো একটি রাষ্ট্র বিদ্যুতে এগিয়ে। পাশের দেশ ভারত সফল হচ্ছে। আমাদের গ্যাসের সন্ধান এবং ব্যবহারটাও ঠিকঠাক করতে পারলাম না। আমরা কেন বসে আছি? আমাদের বিদ্যুতের সমস্যার জন্য মূলত পলিসি ও কৌশলগত অব্যবস্থাপনা দায়ী বলে মনে করি। নইলে এভাবে দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না।’
এমন অসঙ্গতি থাকার পরেও সরকার কেন এমন অব্যবস্থাপনায় আটকে থাকছে? বিশ্লেষণে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মূলত, সরকার আর জনদায় উপলব্ধি করে না। জনগণের কাছে সরকার কোনো জবাবদিহি করার প্রয়োজনবোধ করে না। আমাদের গ্যাস অত্যন্ত উন্নতমানের। তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। এ নিয়ে আপনি প্রশ্ন করতে পারবেন না। সরকার জ্বালানি নিয়ে কোনো নীতি গ্রহণ না করলেও সমালোচনা ঠেকাতে নানা আইন করছে, দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে রেখেছে।’
‘এই সরকার তো দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। জ্বালানি নিয়ে সঠিক পলিসি গ্রহণ করতে পারতো। তা না করে জনগণকে জিম্মি করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। মানুষের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। সরকার যা ইচ্ছা, তাই করছে। সংকট কাটাতে সরকার এলএনজি, তেল, কয়লা আমদানি করছে। এতে আরও সংকট বাড়ছে। গোড়ায় গলদ রেখে আমদানি করে কোনো লাভ হয় না। ডলার সংকট সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে। সামনে ডলার সংকটের আরও কী পরিস্থিতি হবে তা বলা মুশকিল। সরকার তো বিকল্প নিয়ে কোনো ভাবনা করেনি। ১৫ বছর একটি সরকারের জন্য অনেক সময়।’
সরকার পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, তা একদিন গলার কাঁটা হবে। তখন পুরোপুরি আমদানির দিকেই যেতে হবে। আবার যাদের কাছ থেকে আমদানি করবো, সেখানে রাজনীতি আছে। এই রাজনীতি তো বাংলাদেশের জন্য টেকসই না। অর্থনীতির ওপর রাজনীতি চেপে বসলে কোনোভাবেই সুফল বয়ে আনে না। আমরা যে অঞ্চলে বাস করছি, সবাই তো সহযোগিতার জায়গায় নেই। আসিয়ানের সদস্য দেশ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাউস যা করতে পারবে, আমরা তা করতে পারবো না রাজনীতির কারণেই। এটি আমাদের জন্য ট্র্যাজেডি।’
‘আমি আগেই বলেছি, জনদায় এবং জবাবদিহিতা থাকলে জ্বালানি খাতের এই হাল হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ সরকার কয়লা আমদানি করছে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে। আদানি ভারতেই বিতর্কিত। গুজরাট মডেলে নরেন্দ্র মোদীকে আদানি বেশি প্রমোট করেছে। সেই আদানিকে ব্যবসা পাইয়ে দিয়েছেন মোদী। সবই রাজনীতি। আমরা এমন রাজনীতির শিকার। এটিই আমাদের জন্য দুঃখজনক ঘটনা।’ বলছিলেন, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। জাগোনিউজ।