ইমতিয়াজ মাহমুদ: এক-দেড় বছরে দ্রব্যমূল্য যে হারে বেড়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার নতুন কিছু নেই—নিতান্ত উচ্চবিত্ত ধরনের অল্পকিছু মানুষ যারা আছে ওরা ছাড়া দেশের সব মানুষই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির শিকার। কাঁচা মরিচ থেকে সোনাদানা বাজারদর আকাশ স্পর্শ করেনি এমন পণ্যের নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন।
জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে তা যে একদম কমে না তা নয়- দাম একবার আকাশ ছুঁয়ে ফেলার পর আবার খানিকটা কমেও যায় কখনো কখনো। কিন্তু এইরকম দাম কমে গেলেও দেখা যায় যে কমে যাওয়া দামটাও পূর্বের দামের চেয়ে খানিকটা বেশি। এইরকম মূল্য বৃদ্ধি এবং আরও বৃদ্ধি এইসব নিয়ে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা করি, ক্ষোভ প্রকাশ করি কিন্তু ক্ষোভটা সাধারণত প্রকাশিত হয় ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ নামক একদল অদৃশ্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
কারা যে এই সিন্ডিকেট আর কারা যে এই অসাধু ব্যবসায়ী তা সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না—সরকারও যে ওদের চিহ্নিত করতে পারে বা করতে চায় তাও মনে হয় না।
আমি নিবেদন করি এইখানে আমাদের কিছু ভ্রান্তি রয়ে গেছে। প্রথম ভ্রান্তিটা ‘সিন্ডিকেট’ আর দ্বিতীয় ভ্রান্তিটা ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ এবং দুই ভ্রান্তি মিলে অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছেন যার মূল দায় সেই সংস্থাটি আড়াল হয়ে যায়। সিন্ডিকেট নিয়ে ভ্রান্তিটা কী? তাহলে তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতে হয় কে এই সিন্ডিকেট বা কারা এই সিন্ডিকেট?
গণমাধ্যমে জানা যায়, সিন্ডিকেট বলতে আমাদের মধ্যে যে ধারণাটা হয়েছে তা হচ্ছে যে সিন্ডিকেট মানে হচ্ছে একটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের একটি অনানুষ্ঠানিক সংঘ, যারা একত্রিত হয়ে বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে ওদের যে ক্ষমতা তা ব্যবহার করে কোনো একটি বা একাধিক পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
ধরুন, সয়াবিন তেল। বাংলাদেশে এর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এই রকম উৎপাদক ও আমদানিকারকরা, এরা চাইলে সবাই মিলে তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে- হয়তো ১০০ টাকার পণ্যের দাম ওরা ২০০ টাকায় তুলে দিল, ২৫-৩০ দিন পর তা কমিয়ে আবার দেড়শতে নামিয়ে নিয়ে এলো।
এর মধ্যে ওদের দামটা স্থায়ী ভাবে বেড়ে গেল আবার মাঝখানে বিশাল অঙ্কের একটা বাড়তি মুনাফা ঘরে তুলে নিলো। সব পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো সিন্ডিকেটের পক্ষে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বাস্তবে সম্ভবও হয় না, কোনোটা অন্যের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে।
‘অসাধু ব্যবসায়ী’ কথাটার মধ্যে একটা সমস্যা আছে। মানুষ ব্যবসা করে মুনাফার জন্য এবং সব ব্যবসায়ীই চেষ্টা করবে মুনাফার হার যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে। সুতরাং সাধারণভাবে মুনাফা করতে চায় বলেই ব্যবসায়ীদের আপনি অসাধু বা অসৎ বলতে পারেন না। অতিরিক্ত মুনাফার জন্যও না—কেননা ঠিক কতটা মুনাফা করলে তা সৎ মুনাফা হবে আর কতটা করলে অসৎ হবে সেই রকম কোনো মান তো কেউ নির্ধারণ করেনি।
আর এই কথাটাও তো ভুল নয় যে ব্যবসায়ীরা ঠিকঠাক মতো মুনাফা করতে পারলে তবেই তো বাজার অর্থনীতি চাঙা হবে। ব্যবসা তো সমাজসেবা নয়, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তাই বলে কি বাজারে ব্যবসায়ীরা, সিন্ডিকেট করে হোক বা না করে হোক, ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়াবে? কেউ কি ওদের নিয়ন্ত্রণ করবে না?
এত বড় একটা রাষ্ট্রযন্ত্র, কত এর কর্মকর্তা, কত এর কামান বন্দুক! রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন- যাকে আমরা বলি রাষ্ট্রনায়ক, তার কাজ কী? সরকারের কি কিছু করণীয় নেই? কোনো ক্ষমতা নেই? আর যদি করণীয় কিছু থাকে বা ক্ষমতা কিছু থাকে সরকার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে না কেন? এটা একটা বৈধ প্রশ্ন এবং এইটাই মূল প্রশ্ন।
আমরা জানি যে, আমাদের সরকার নীতি হিসেবে বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছে। বাজার অর্থনীতির মূল কথাটা কী? মূল কথা হচ্ছে যে সরকার ব্যবসা বাণিজ্য করবে না, এগুলো সব হবে বেসরকারি খাতে, আর বাজারের মূল্য নির্ধারিত হবে সরবরাহ বা জোগান ও চাহিদার পারস্পরিক সমীকরণের মাধ্যমে।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বাড়লে পণ্যের দাম কমে যাবে, আর চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। এইখানে কি রাষ্ট্রের বা সরকারের কিছু করার আছে? উত্তর হচ্ছে যে আছে, সরকারের অনেককিছু করার আছে, কিন্তু সরকার তা করতে চায় কি চায় না তা হচ্ছে সরকারের একটা নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
যাকে আমরা সিন্ডিকেট বলছি, ওরা সরবরাহ দিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় যাতে করে পণ্যের মূল্য চড়া থাকে। সরকার সবসময়ই চাইলে সেইখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে- কিন্তু দৃশ্যত আমাদের দেশের সরকার রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে বাজারে ওরা হস্তক্ষেপ করবে না। বাজারে যে অস্থির অবস্থা আমরা দেখছি তা হচ্ছে সরকারের সেই রাজনৈতিক বা নীতিগত সিদ্ধান্তের ফল।
সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই কথাটাও সম্পূর্ণ ঠিক না। সরকার বাজারে একটা নিয়ন্ত্রণ ঠিকই আরোপও করে রাখে- তা হচ্ছে আমদানি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সমূহ কেউ চাইলে যখন ইচ্ছে তখন যা ইচ্ছে সেই পরিমাণে আমদানি করতে পারে না, সরকারের অনুমতি, অনুমোদন ইত্যাদির দরকার হয়। এই যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, তাও ব্যবসায়ীদের অনুকূলেই কাজ করে।
কেননা ব্যবসায়ীরা জানে যে ওরা যদি সরবরাহে কয়েকদিনের জন্য হলেও একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে তাহলে দ্রব্যমূল্য রকেটের মতো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাবে- কেননা চাইলেই তো অন্য কেউ একজন হুট করে সেই পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এর ফলে আমরা যতই দাবি করি যে সরকার সিন্ডিকেট ভেঙে দিক বা দ্রব্যমূল্যের দাম নির্ধারণ করে দিক তা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না- সরকারের নীতিগত অবস্থানই তা হতে দেয় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যেমন সরকারের, এর ব্যর্থতার দায়ও সরকারের।
অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট ইত্যাদি বলে কোনো লাভ নেই। একটা দেশের সম্পূর্ণ বাজার ব্যবস্থার হাল কতিপয় ব্যক্তির বদান্যতা বা সাধুতার ওপর নির্ভরশীল হবে তা তো কোনো কাজের কথা নয়।
সরকারের মৌলিক নীতির পরিবর্তন করতে হবে। সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে প্রয়োজনে সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করবে। হস্তক্ষেপ দুইভাবে হতে পারে। এক হচ্ছে সরকার নিজে সরবরাহ করতে পারে। স্বাধীনতার পর টিসিবি গঠিত হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যেই।
দ্বিতীয় পন্থা হচ্ছে, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির নীতিমালা শিথিল করে দেবে, যাতে করে বাজারে একটু অস্থিরতা দেখা দিলেই ব্যবসায়ীদের কেউ না কেউ চট করে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। আমদানি শিথিল করার ক্ষেত্রে শুল্ক কর এসব বাড়িয়ে কমিয়েও বাজারের ওপর খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
আর এই যে এখন সরকারের ভোক্তা অধিকার দপ্তর হাটে বাজারে দৌড়াদৌড়ি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে এটা কী? এটা হচ্ছে জনগণকে দেখানো যে না, আমরা একটা কিছু করছি। কেননা আইনত ভোক্তা অধিকার দপ্তরের কোনো ক্ষমতা নেই যে আপনি একটা পণ্য কত দামে বিক্রি করবেন বা কত মুনাফা করবেন তা নির্ধারণ করে দেবে।
আপনি একশ টাকা দামে চাল কিনে খুচরা বাজারে যদি এক হাজার টাকা দামে বিক্রি করেন তাহলে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তাদের কোনো ক্ষমতা নেই যে ওরা আপনাকে বলবে যে আপনি এত মুনাফা কেন করছেন? তাহলে ওদের ম্যাজিস্ট্রেটরা গিয়ে যে জরিমানা করে, ধমকাধমকি করে তা আসলে কী?
আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, ঐসব ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা দোকানদারদের জরিমানা করে মূল্য তালিকা না ঝুলানোর জন্য বা ঐরকম নানারকম তুচ্ছ অপরাধে। যেসব পণ্যের গায়ে দাম লেখা থাকে, যেমন—ওষুধ, বিস্কুট, বোতলে ভরা তেল ইত্যাদি পণ্য যাতে নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়ে তা ভোক্তা অধিকার দপ্তর দেখতে পারে। কিন্তু অন্যসব পণ্য আপনি কত দামে বিক্রি করবেন আর কত মুনাফা করবেন তা নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা আইনে দেওয়া হয়নি।
ভোক্তা অধিকার দপ্তরের লোকজন খুব ছোটাছুটি করে, পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে গিয়ে দোকানদারদের ভয় টয় দেখায়। এগুলো দেখে আমরা খানিকটা শান্তি পাই, আমোদও পাই—কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এইগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না। সরকার যদি চায় তাহলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—তার জন্য সরকারকে আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ওরা তা করবে। এখন সরকারের বিদ্যমান সিদ্ধান্ত হচ্ছে সরকার বাজারে হাত দেবে না। সুতরাং দ্রব্যমূল্য এইভাবেই চলবে।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।