ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ জনগণের কষ্টে দুঃখ প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানায় উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রাস্ফীতিকে দুশ্চিন্তার কারণ, তবে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মত দিয়েছেন।
সরকারের পরিসংখ্যান কার্যালয়, বিবিএস এরই মধ্যে জানিয়েছে, গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা বিগত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রসঙ্গত, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে, সারা বছরের জন্য বাজেটে নির্ধারিত ৫ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মুুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী একজন দক্ষ হিসাবরক্ষক। তিনি হয়তো ভাবেন, করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ সংকট, বর্ধিত চাহিদা, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পণ্যমূল্য বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অন্যদিকে, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের অনেকের ধারণা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদা-সরবরাহের ফারাক, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য অথবা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, কোনো ব্যাখ্যাই সাধারণ মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক নয়। তারা নিত্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধিতে কষ্টে আছে, তাদের জীবনমানের অবক্ষয় হচ্ছে। কোনো ব্যাখ্যাই ভুক্তভোগীদের আশ্বস্ত করতে পারছে না।
তারা মনে করে, সরকারের ব্যর্থতার কারণে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে সৃষ্ট অসন্তোষ ফল প্রভাবিত করতে পারে।
পণ্যমূল্য সহনীয় করার উপায় কীপ্রধান প্রধান গণমাধ্যম, পত্রিকা ও টেলিভিশন নিয়মিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং তাদের তদারকিতে ও নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দোষারোপ করছে। এ অভিযোগের ভিত্তি থাকলেও পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা নয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার তদারকি এবং অভিযান পরিচালনা, ব্যবসায়ী নেতা, উৎপাদক, পরিশোধনকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ও দেনদরবারের মাধ্যমে কিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সফলতা লাভ করেছে। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় তা কোনো অবদান রাখছে বলে মনে হয় না। সরকারের নির্দেশে টিসিবি এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে কয়েকটি পণ্য বিক্রি করছে। এতে সুবিধাভোগী দরিদ্র পরিবার উপকৃত হচ্ছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি থামছে না। হতাশ হয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যথার্থই বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সামান্যই করার আছে।
বিশ্ব বাজারে ক্রমান্বয়ে অনেক পণ্যেরই মূল্য কমে আসছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় ভোক্তাদের মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষার জন্য মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার ‘সুদের হার’ বৃদ্ধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবেশী ভারতে গত এপ্রিলে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা অক্টোবর ২০২১ সালের পর সর্বনিম্ন। মে মাসে ইউরো জোনে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে কম। এপ্রিলে কানাডা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩, ৪ দশমিক ৩ ও ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। চীনে মে মাসে মূল্যবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ, যা দুই বছরে সর্বনিম্ন, আর ভিয়েতনামে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিগত ১৪ মাসে সবচেয়ে কম। এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ০ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশে পণ্যমূল্য হ্রাস পাচ্ছে। স্পষ্টতই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দেশে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে দেখানো খোঁড়া যুক্তি। বস্তুত সারা বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, বাংলাদেশ তা থেকে বিরত থেকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ হার ৬.০ শতাংশ এবং ঋণের সর্বোচ্চ হার ৯ দশমিক ০ শতাংশ নির্ধারণ করে এবং সময়ের সঙ্গে তা সংশোধন না করে জেদিভাবে তা অনুসরণ করে আসছে। অন্যদিকে বিগত জুলাই-মে ১১ মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। টাকশালে টাকা ছাপিয়ে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এতে অর্থনীতিতে পাঁচ গুণ অর্থাৎ তিন লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে (তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বড় অঙ্কের অর্থ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার দাবি করছে)। অর্থ সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ছে। বার বার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আমদানি ব্যয় থেকে পরিমাণে অনেক কম হওয়ায় বিগত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ২৫ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধির ফলে টাকায় আমদানি ব্যয় বহুলাংশে বাড়ছে ও মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দিচ্ছে। বিশ্ব বাজারে অনেক পণ্যের ব্যাপক দরপতনের সুফল থেকেও বাংলাদেশের ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকের ধারণা, বাংলাদেশ যদি বাজারভিত্তিক ক্রমহ্রাসমান বিনিময় হার অনুসরণ করত, তাহলে বিনিময় হারের ব্যাপক দরপতন ও ডলার সংকট আদৌ দেখা দিত না। একইসঙ্গে ৯-৬ সুদের হারের পরিবর্তে বাজারভিত্তিক সুদের হার নিরূপণ করা হলে সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকেও স্থিতিশীলতা বজায় থাকত।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ০ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন। সরকারের ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিং খাত, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণের সম্ভাবনা কিন্তু শুভ লক্ষণ নয়। এতে মুদ্রাস্ফীতি আরো লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩-এর মুদ্রানীতি প্রকাশ করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায়, এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ‘৯-৬’ সুদের হার নির্ধারণ এবং তা কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এতে ‘সুদের হার’ বাজারভিত্তিক হবে না। তাঁদের মতে, মুদ্রাস্ফীতি এক জটিল রোগ, এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ওষুধের প্রয়োজন। সুদের হার ১-২ শতাংশ বৃদ্ধি করে কোনো কাজ হবে না। সরকার যদি মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে চায়, তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদের হার নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের ব্যবসাবান্ধব ‘সুদনীতি’ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে না। আর সমষ্টিগত অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে স্থিতিশীলতা অর্জন ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানাও দুরূহ হবে।
মূল্য পরিস্থিতি একদিনে বর্তমান পর্যায়ে আসেনি, তাৎক্ষণিক ভাবে তা নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক। তবে তা পর্যাপ্ত না-ও হতে পারে। বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল নয়। সরবরাহ সামান্য হ্রাস পেলে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ১৯৯১ সাল থেকে অনিয়ন্ত্রিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ অনুসরণের প্রেক্ষাপটে দেশে গুটিকয়েক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ধারণা করা হয়, বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে। জনজীবনে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ফল মূল্যায়ন করে এর উপযোগিতা পুনর্নির্ধারণ ও সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করি। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে মূল্য কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। অতএব গুটিকয়েক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও কাটেলের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সরকার খাদ্য বিভাগ, টিসিবির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ ও বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকারের ব্যবসা থেকে দূরে থাকার নীতিতে জনস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। সরকারের ‘ভোক্তাবান্ধব, জনবান্ধব’ নীতি গ্রহণের সময় এসেছে। ন্যায্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ, ভোক্তা স্বার্থসংক্রান্ত বিষয় তদারকি- এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোক্তা সম্পর্কিত একটি বিভাগ সৃষ্টি সময়োপযোগী হবে মনে করি। অন্যদিকে বাণিজ্য সম্পর্কিত অন্য একটি বিভাগ বাণিজ্যনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, বাণিজ্যিক সংস্থা ইত্যাদি বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারে।
প্রসঙ্গত, ভারত সরকার নব্বইয়ের দশকে ভোক্তা স্বার্থ দেখার জন্য ‘কেন্দ্রীয় ভোক্তা সুরক্ষা মন্ত্রণালয়’ নামের একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে।
পণ্যমূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে তা পূর্বাবস্থায় নেমে আসবে- এমন প্রত্যাশা করা যায় না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় অথবা গত শতাব্দীতে বা পরবর্তী সময়ে মূল্য পরিস্থিতি যেমন ছিল, তা আবার ফিরে আসবে আশা করা অবাস্তব। সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার মূল্যস্ফীতির চেয়ে অধিক হারে বাড়লে তাদের জীবনমানের উন্নতি হয়, কল্যাণ বাড়ে। মুদ্রাস্ফীতির আঁচ সহনীয় হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে, দেশের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশের কাতার থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাসে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সব মানদণ্ড অর্জন করেছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ ১০ বছরের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে। স্বাধীনতা অর্জনের সময় দেশের মানুষের ৮০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, আর এখন তা ২০ শতাংশেরও কম। তবে সংখ্যায় তিন কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয় এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। অন্যদিকে পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের তুলনায় দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে।
২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বৈষম্যের পরিমাপক Gini Index ০ দশমিক ৪৬ থেকে ০ দশমিক ৫৭-এ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নআয়ের ৫০ শতাংশ জনগণের ব্যক্তিগত সম্পদের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশের মালিকানার বিপরীতে উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশের মালিকানা ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আয় ও সম্পদের এই তির্যক পার্থক্যের প্রেক্ষাপটে দরিদ্র, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং স্থির আয়ের জনসাধারণ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে সর্বাধিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারের মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার লাগসই নীতি অনুসরণ এবং সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি, তাদের কল্যাণ ও জীবনমানের উৎকর্ষের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পরিস্থিতি সহনীয় হতে পারে। সরকার সে চেষ্টা করছে। তবে তা সময়সাপেক্ষ। বাধাও আছে অনেক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণাসূচকে বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পর পর পাঁচ বছর পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরে অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, তবে এখনো সূচকে আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের সূচক বর্তমানে ৩০-এর বেশ নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম অতি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। দুর্নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে। দুর্নীতি রোধে আরও জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন।
জ্বালানি, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানোন্নয়ন উন্নয়নের সোপান। সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা অর্জন উন্নয়নের আবশ্যকীয় উপাদান। আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুশাসন। সরকারের নীতি হবে পক্ষপাতিত্বহীন। একপেশে ‘ব্যবসাবান্ধব’ নীতি নয়, সরকারের নীতি হবে ‘ভোক্তাবান্ধব, জনবান্ধব’। তবেই ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পরিস্থিতিও সহনীয় ও কল্যাণকর বিবেচিত হবে।
লেখক : গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব।
সৌজন্যে, কালের কণ্ঠ।