ড. কবিরুল বাশার: বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ মোটামুটি সফল ভাবে মোকাবিলা করেছে। মানুষ থেকে মানুষের ছড়ানো এই ভাইরাসটি মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছে বাংলাদেশ।
দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা পরিচিত শত্রু এডিস মশা এবং তার দ্বারা সংক্রমিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু হয়েছে। ডেঙ্গু এবং এর বাহক মশা সম্বন্ধে সবাই অবগত এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আমাদের জানা। তারপরেও আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষণাগার সবসময়ই মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করে। আমরা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, মাঠ পর্যায়ের এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এই কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি। যার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্বন্ধে আগাম ধারণা দিতে পারি।
আমাদের গবেষণাগার থেকে আমরা যে আগাম তথ্য দিয়েছি সবগুলোই সঠিক হয়েছে। আমাদের বর্তমান ফোরকাস্টিং মডেল বলছে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। শুধুমাত্র ঢাকায় নয় বাংলাদেশের সব জায়গায় ডেঙ্গু আরও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা একটি মডেল তৈরি করেছি। এই মডেল অনুযায়ী পাঁচ বছর কার্যক্রম চালাতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে বলে আমি নিশ্চিত করতে পারি। ধারণা করা হয়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আমাদের এই মডেলটি বাস্তবায়নে যে ব্যয় হবে তা মোট নিয়ন্ত্রণ ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম হবে। মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত ‘কেবি মডেল’ নিম্নরূপ-
১. স্বাস্থ্যকর্মী: প্রতি এক হাজার হোল্ডিং বা বাড়ির জন্য একজন করে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে এই জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে। এই স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে প্রতিটি বাড়ির মালিকের ফোন নাম্বর এবং ঠিকানা থাকবে। বাড়ির মালিকের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ থাকবে। তার দায়িত্বে থাকা কোনো বাড়িতে কারও কোনোরকম জ্বর হয়েছে কি না সেই তথ্য নিয়মিতভাবে তার কাছে থাকতে হবে।
প্রতি ১৫ দিনে একদিন তার নির্ধারিত বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিকপক্ষের কাউকে নিয়ে সম্পূর্ণ বাড়ি এবং বাড়ির আঙিনা ঘুরে দেখতে হবে কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমা আছে কি না, যেখান থেকে ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশার প্রজনন হতে পারে। যদি ওই বাড়িতে এডিস মশা জন্মাতে পারে বা জন্মেছে এমন কোনো ধরনের পাত্র পাওয়া যায় তাহলে সেই বাড়ির লোক দিয়ে তা পরিষ্কার করতে হবে।
তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে কীভাবে এই কাজটি করতে হয়। নিয়মিত ভাবে তাদের এই কাজ করার জন্য অনুরোধ করতে হবে। যদি কোনো বাড়িতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় তাহলে সেই বাড়ির মালিকদের মশার লার্ভা সম্পর্কে সম্মুখ জ্ঞান প্রদান করতে হবে। বাড়ি ভিজিট করার সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য এবং উপাত্ত ডেঙ্গু নিধন অ্যাপে এন্ট্রি দিতে হবে।
এন্টি দেওয়ার পরেই কেন্দ্রীয় টিম, জিআইএস টিম, র্যাপিড রেসপন্স টিম তা দেখতে পাবে। যদি কোনো বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী থাকে এবং এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় তাহলে কেন্দ্রীয় র্যাপিড রেসপন্স টিম দ্রুত ওই বাড়ি এবং তার আশেপাশে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেবে। মশা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে তাও অনলাইন অ্যাপে এন্ট্রি দিতে হবে যেন কেন্দ্রীয় টিম তা সহজেই মনিটরিং করতে পারে।
স্বাস্থ্য কর্মীর কাছে তিন ধরনের স্টিকার থাকবে- সবুজ, হলুদ এবং লাল। যদি কোনো বাড়িতে পানি জমা না থাকে তাহলে সেই বাড়িতে সবুজ স্টিকার লাগানো, এডিস মশার প্রজনন স্থল আছে কিন্তু লার্ভা নেই এমন বাড়িতে হলুদ আর যদি লার্ভা পাওয়া যায় তাহলে সেই বাড়িতে লাল স্টিকার লাগিয়ে দিতে হবে।
বাড়ির মালিককে জানাতে হবে কোনো কারণেই এই স্টিকার তুলে ফেলতে পারবে না। স্টিকার তুলে ফেললে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে ডেঙ্গু টেস্ট করার কিট থাকতে হবে। ওই বাড়ির কারও জ্বর থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করিয়ে দিতে হবে। যদি কোনো বাড়িতে ডেঙ্গু পজিটিভ পাওয়া যায় তাহলে সিটি কর্পোরেশনের চিকিৎসকের সাথে তার সংযোগ করিয়ে দিতে হবে।
সিটি কর্পোরেশনের চিকিৎসক নিয়মিত ভাবে তার খোঁজখবর রাখবেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেবেন। তার অধীনে থাকা প্রতিটি বাড়ির প্রতিবার পর্যবেক্ষণের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ছবিসহ অ্যাপে আপলোড করতে হবে। শুধুমাত্র আবাসিক এলাকা নয় একজন স্বাস্থ্যকর্মীর অধীনে তার এলাকার নির্ধারিত সব হোল্ডিংগুলোই থাকবে। তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা অফিস আদালতও হতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৫ দিনের মধ্যে একদিন যেতেই হবে এবং সেই বাড়ির সব তথ্য অনলাইনে আপলোড করতে হবে। এই জাতীয় ডাটা ম্যানেজমেন্টের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফ্রি অ্যাপস আছে। অথবা সিটি কর্পোরেশন নিজেরাও এই অ্যাপ তৈরি করে নিতে পারে।
২. ক্লিনার: প্রতিটি ব্লকে একজন করে ক্লিনার থাকবে। ক্লিনারের কাজ হচ্ছে যেকোনো পাত্রে জমা পানি বা আটকে যাওয়া ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি প্রবাহিত রাখা। কারণ আবদ্ধ পানিতে মশা জন্ম হয়। সাথে সাথে তার ব্লকের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পাত্র যেখানে এডিস মশা জন্মানোর সম্ভাবনা আছে সেইগুলো পরিষ্কার রাখা।
৩. মশককর্মী: একটি ওয়ার্ডকে ৮ থেকে ১০টি ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকে দুইজন করে মশককর্মী দিতে হবে যারা সকালে লার্ভিসাইড এবং বিকালে এডাল্টিসাইড স্প্রে করবে। প্রতি তিন দিন পরপর অবশ্যই একটি এলাকায় লার্ভিসাইড এবং এডাল্টিসাইড স্প্রে নিশ্চিত করতে হবে। আর এই নিশ্চিতকরণের দায়িত্বে থাকবে একজন ওয়ার্ড সুপারভাইজার। ওয়ার্ড সুপারভাইজার কাজ নিশ্চিত করে আঞ্চলিক কীটতত্ত্ববিদদের রিপোর্ট করতে হবে।
৪. সুপারভাইজার: একটি ওয়ার্ড এর জন্য একজন সুপারভাইজার থাকবে। তিনি তার ওয়ার্ডের সব স্বাস্থ্যকর্মী ও মশককর্মীদের নিয়মিত কাজ নিশ্চিত করবেন। স্বাস্থ্য কর্মীদের কাজের মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন ওয়ার্ড কমিটিকে প্রদান করতে হবে। তার ওয়ার্ড এ প্রতিটি বাড়ির মশাবাহিত রোগের খবরাখবর রাখতে হবে।
তার ব্লকে কোথায় মশা জন্মানোর স্থান আছে সেইটি কিউলেক্স মশা না এডিস মশা তার রেকর্ড তার কাছে থাকতে হবে। সাথে সাথে তার ব্লকের জনগণকে সচেতন করা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব তার থাকবে। তার অধীনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত মোবাইল অ্যাপে এন্ট্রি দিচ্ছে কি না তা মনিটরিং করবেন।
৫. সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা: প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে চিকিৎসক সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে থাকবেন। তিনি সুপারভাইজারের কাছ থেকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা, তার প্রজননস্থল, ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগী ইত্যাদি সব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। তার ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ও খবরাখবর রাখবেন। তিনি তার আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে নিয়মিত মাসিক সভায় প্রতিবেদন জমা দেবেন।
৬. আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন: পৃথিবীতে কোনো নাগরিকের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ করা কখনোই সম্ভব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার জন্য পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে। সেই রকম একটি আইন বাংলাদেশে তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কোনো ব্যক্তি যেন তার নিজ জায়গায় মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে অপরের ক্ষতি করতে না পারে তা রোধ করাই এই আইনের উদ্দেশ্য।
৭. মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের পর্যাপ্ততা: মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক জনগণের হাতের নাগালে আনতে হবে। তেলাপোকা এবং ইঁদুর মারার কীটনাশকের মতো মশা নিয়ন্ত্রণের কীটনাশক মানুষের কাছে সহজলভ্য হতে হবে। যেন মানুষ সহজেই এই কীটনাশক কিনে তার বাড়ি এবং আশেপাশে ব্যবহার করতে পারে।
৮. কীটনাশক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ: আমাদের দেশে একটি কীটনাশক বাজারজাত করতে গেলে যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া রয়েছে তাতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। একটি কীটনাশক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার পরে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
মশক নিয়ন্ত্রণ বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য নিম্নলিখিত কমিটি করা যেতে পারে—
কেন্দ্রীয় কমিটি:
কমিটির সদস্য: মেয়র, উপদেষ্টা বা পরামর্শক, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা, উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, জিআইএস এক্সপার্ট ও কাউন্সিলর।
কাজ: প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও মশক সমস্যা বিষয়ক মূল্যায়ন সভা। প্রতিটি ওয়ার্ডকে লিখিত আকারে পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রদান। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক, লোকবল, এবং সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করা।
জিআইএস টিম
কমিটির সদস্য: প্রধান জিআইএস এক্সপার্ট, কীটতত্ত্ববিদ, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
কাজ: স্বাস্থ্যকর্মীরা যে তথ্য উপাত্ত অ্যাপে এন্ট্রি দিচ্ছে তা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও ম্যাপে রূপান্তর। ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণ। হটস্পট অনুযায়ী র্যাপিড রেসপন্স টিমের কাছে বাড়ির ঠিকানা ও তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করা। র্যাপিড রেসপন্স টিমের কার্যক্রম নিশ্চিত করা।
মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন টিম
কমিটির সদস্য: এটি সিটি কর্পোরেশনের বাইরের কোনো অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে করিয়ে নিতে হবে।
কাজ: দুই মাস অন্তর অন্তর প্রতিটি ওয়ার্ডের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও মশক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের মশার ঘনত্ব ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করবেন। তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনলাইনে এন্ট্রি করবেন। এতে স্পষ্ট হবে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে যে কার্যক্রম করা হয়েছে তা আসলে ফলাফল দিয়েছে কি না।
ওয়ার্ড কমিটির কার্যক্রম কতটা ফলপ্রসূ হলো তা এই মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন টিমের তথ্য উপাত্ত থেকে তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে এবং এটি সরাসরি অনলাইনে দেখা যাবে। মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন টিম তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সরবরাহ করবে এবং এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় কমিটির পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
র্যাপিড রেসপন্স টিম
কমিটির সদস্য: কীটতত্ত্ববিদ, মশক সুপারভাইজার, স্প্রে-ম্যান, ফগারম্যান, ক্লিনার, ড্রাইভার।
কাজ: জিআইএস টিমের তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী কোথাও ডেঙ্গুর রোগী পাওয়া গেলে সেই বাড়ির ৪০০ গজের মধ্যে উড়ন্ত মশা নিধন নিশ্চিত করা। কোথাও এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেলে সেইখানেও মশা নিধন নিশ্চিত করা। তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করে মোবাইল অ্যাপে এন্ট্রি দেওয়া।
আঞ্চলিক কমিটি
কমিটির সদস্য: সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে আঞ্চলিক কমিটি থাকতে হবে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, মশক সুপারভাইজার।
কাজ: তার অঞ্চলে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করা। কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করা। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর প্রতিটি ওয়ার্ডের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও মশক সমস্যা বিষয়ক মূল্যায়ন সভা। প্রতিটি ওয়ার্ডকে লিখিত আকারে পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রদান। মশা নিয়ন্ত্রণে তার অঞ্চলে কীটনাশক, লোকবল, এবং সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করা।
ওয়ার্ড কমিটি
কমিটির সদস্য: সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ওয়ার্ড কমিটি থাকতে হবে। কাউন্সিলর, সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মশক সুপারভাইজার।
কাজ: তার ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করা। আঞ্চলিক কমিটিকে অবহিত করা। প্রতি মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও মশক সমস্যা বিষয়ক মূল্যায়ন সভা। মশক সুপারভাইজারকে লিখিত আকারে পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রদান। মশা নিয়ন্ত্রণে তার ওয়ার্ডে কীটনাশক, লোকবল, এবং সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করা।
কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময় উপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জামাদি এবং আধুনিক কীটনাশক নির্দেশিকা এই গাইডলাইন থাকবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারাদেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সেন্টার তৈরি করতে পারে। যার নাম হতে পারে বাংলাদেশ ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার। এই সেন্টারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। এই সেন্টারে বছরব্যাপী মশা, অন্যান্য বাহক ও কীটনাশক নিয়ে গবেষণা হবে এবং তারাই নির্দেশনা দিবে কখন, কোন কীটনাশক কোন বাহকের জন্য ব্যবহৃত হবে।
বাহকের আচরণ এবং নতুন নতুন বাহকের ক্ষেত্রে কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে তার দায়িত্ব তাদের ওপর থাকবে। এই সেন্টারে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দিতে হবে। এই সেন্টার দেশব্যাপী মশা ও অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের বাহকের আচরণ, প্রজনন এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। সাথে সাথে মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জাম ও কীটনাশক সরবরাহ করবে।
ডেঙ্গু যেহেতু এখন সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মশক নিধনে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পরিষদ প্রতিটি জায়গায় তাদের মশক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
প্রতিটি জেলাতে জেলা কীটতত্ত্ববিদের একটি পদ রয়েছে। কোনো কোনো জেলায় এই পদে কর্মকর্তা রয়েছে। যেসব জেলায় পদগুলো ফাঁকা রয়েছে সেইসব জেলাতে এই পদগুলো পূরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণ কাজ জোরদার করা প্রয়োজন।
ডেঙ্গুর আগ্রাসী প্রভাবের বছর গেল ২০২৩। আগামী বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের হারে ঢাকাকে ছাড়িয়ে অন্যান্য জেলা শহরগুলোয় নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করবে। ভবিষ্যৎ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভালো হয়ে গেলে নীতি নির্ধারকরা ভুলে যাবেন না। আগামী বছরগুলোর জন্য একটি টেকসই পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য উদ্যোগী হবেন নিশ্চয়ই।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।