ওয়াসায় জনগণের মালিকানা কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

এস এম নাজের হোসাইন: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হলো। ইতোমধ্যে স্বৈরাচারের অনেক দোসর নিজেরাই পদত্যাগ ও পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। বহুল আলোচিত ঢাকা ওয়াসায়ও তার ধাক্কা লেগেছে। আজীবন লিজ নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ঢাকা ওয়াসাসহ সব ওয়াসার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জনগণের মালিকানা নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি।

কারণ এগুলো কাউকে কাউকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। প্রায় সময় গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বৃদ্ধির খড়্গ নেওয়া হতো লোকসান কমানোর কথা বলে। যদিও ক্যাবসহ নানা নাগরিক সংগঠনের ভিন্নমত থাকলেও সেটি আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। রাবার স্ট্যাম্পের মতো একটি পরিচালনা পর্ষদ ছিল, যা অনেকটাই লোক দেখানো।

পানি প্রত্যেক নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করবে। সে আলোকে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় জনগণের অত্যাবশ্যকীয় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসাকে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে রয়েছে নানা মহলের অভিযোগ।

শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানিও সরবরাহ করতে পারে না ওয়াসা। এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। তবু নিয়মিতই মুনাফা করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। প্রতিনিয়তই ঢাকা ওয়াসা প্রতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করে আসছে। এর পরও নানা অজুহাতে প্রতিবছর পানির মূল্য বাড়ায় ঢাকা ওয়াসা। আর মন্ত্রণালয় সেখানে সায় দেয়।

আলোচনার সুবিধার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ঢাকা ওয়াসার আর্থিক প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওয়াসা মুনাফা করেছিল প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৯৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসানের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, পরিচালন তথা বেতন-ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রয় ও বিতরণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এছাড়া সরকার থেকে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরও ওয়াসা লোকসান করবে বলে প্রাক্কলন করেছে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার মূল সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিত্যনতুন প্রকল্প নিতে বেশি আগ্রহী। পানি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহারে অনিয়ম দূর করা গেলে এবং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানো হলেই লোকসান কমানো সম্ভব। কারণ ঢাকা শহরে যেখানে পানি আছে সেখানে প্রচুর পানির অপচয় হচ্ছে, আর যেখানে নেই সেখানে শুধু হাহাকার। কয়েক দিন আগে পুরো পানি সরবরাহ লবণাক্ত ও ঘোলাটে হয়ে পড়েছিল।

ওয়াসার নীতিনির্ধারকদের হাতে সে খবর ছিল না। পরে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কারণে কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে তদারকি ও কাজের গুণগত মান উন্নয়নে কোনো তৎপরতা নেই। আর অবৈধ সংযোগ, সিস্টেম লস পুরোটা খামচে ধরেছে ওয়াসাকে। অনেক জায়গায় ওয়াসার পানির পাইপ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি নিঃসরণ হয়ে স্যুয়ারেজের লাইনে চলে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো খবরই রাখে না। ওয়াসা চলমান প্রকল্পগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কাজে তদারকিতে বিরূপ মনোভাব রয়েছে।

এছাড়া, যেটি সবচেয়ে ভয়ংকর তা হলো, ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদে ভোক্তাদের কোনো সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ অনুসারে ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি এবং পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

প্রত্যেক প্রতিনিধি তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন কর্তৃক মনোনীত হলেও পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক তারই আজ্ঞাবহকে মনোনীত করে থাকেন। বর্তমান ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানও একই প্রক্রিয়ায় মনোনীত। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক মনোনীত বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যান যে-ই হোক না কেন, তার পক্ষে তার মনোনয়নদানকারীর কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব? আইনের মারপ্যাঁচে বলা আছে, একজন ব্যক্তি কীভাবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী হতে পারেন?

তবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি হতে হলে তাকে ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ থাকতে হবে। আর সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। যেখানে ধারা নং ৫-এর ১৬ উপধারায় বলা আছে, ক্যাব ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। তারই ধারাহিকতায় ক্যাব সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা র্স্বাথসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী ও কমিটিগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করে এলেও ঢাকা ওয়াসায় তা মানা হয়নি।

দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের অভাব। যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সব জনগণ বলা হলেও বর্তমানে শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সকল পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। এ জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে।

যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়ও। যেখানে অনেক খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ী মিলেমিশে নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। অথচ এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এই সেবা সার্ভিস, তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এসব পদও সমাজের ওপরতলার লোকজন দখল করে নেন। নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যার জন্য এই সেবা বা বিধান, তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না?

তাই এখন ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দূর করা, শুধু গ্রাহক পর্যায়ে প্রতিনিয়তই দাম বাড়ানোর চেয়ে সরকারি সেবা সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অনেক বেশি জরুরি। একইসঙ্গে পানির দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির আয়োজন করে ভোক্তাদের মতামত নিয়ে সেবার মান ও দাম নির্ধারণে ভূমিকা নিতে হবে।

কারণ ওয়াসা রাষ্ট্রীয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। জনগণের করের টাকায় এর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। সে কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধসহ নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে পানির দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি থেকে বের হয়ে এসে সেবা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনার মান, পানি ব্যবহারকারীদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ, কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা কাটানো সম্ভব। খবরের কাগজ।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।