ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: মৌসুম শেষ, বর্ষার পর নতুন সবজি বাজারে আসবে, সেই সঙ্গে কাঁচা মরিচের মৌসুমও শেষ, এই সুযোগে ব্যবসায়ীদের চোখ পড়েছে কাঁচা মরিচের দিকে। তাই ঈদের আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার।
আশা করা হয়েছিল, পেঁয়াজের মতো আমদানির অনুমতির সঙ্গে সঙ্গে দাম কমে আসবে। কিন্তু আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে আমদানি বিলম্ব হয়। তাই সরকারের সেই উদ্যোগের সুফল এখনো মেলেনি। যার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ ঈদের আগের দিনও এর দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা।
হঠাৎ করে দাম বাড়তে থাকায় ২৫ জুন থেকে সরকার মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ১৭ হাজার টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ২৭ জুনের তথ্য অনুযায়ী মাত্র ২০ টনের মতো মরিচ এসেছে দেশে। এইদিকে উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঁচা মরিচের উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার টন।
দেশে কাঁচা মরিচের চাহিদা রয়েছে ১৫ লাখ টনের। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে ২৬ জুন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। প্রথম দিনেই ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ১১ হাজার ৬০০ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার।
মরিচ চাষি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, এপ্রিল ও মে মাসে খরার পর হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে বেশিরভাগ মরিচ গাছ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই অধিকাংশ গাছে ফলন ছিল না। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে মরিচ সংগ্রহের কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সরবরাহ ঘাটতিতে অধিকাংশ জায়গায় কাঁচা মরিচের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দাম আকাশচুম্বী হওয়ার পরও বাজারে কাঁচা মরিচের সরবরাহের কোনো কমতি দেখা যায়নি। যেহেতু কারসাজি করে অনেক ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন, কাঁচা মরিচ ব্যবসায়ীরা এইবার সেই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা বছরজুড়ে যেকোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষের পকেট কাটছে। চিনি, পেঁয়াজ, আদা, সয়াবিন তেলের পর এইবার কাঁচা মরিচের ওপর চোখ পড়েছে তাদের। তাই মৌসুম শেষ হওয়ার পর থেকে আকাশ ছোঁয়া দাম এই পণ্যটির। এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
দেশের বাজারে নিত্যপণ্যগুলো যেন পরস্পরের সাথে মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। চাল, ভোজ্যতেল ও চিনির খুচরা মূল্য বহু পূর্বেই অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এক-দেড় মাস ধরে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন মসলা এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে।
দেশে বছরে যে পরিমাণ কাঁচা মরিচ প্রয়োজন হয় তার একটা বড় অংশ চরাঞ্চলে চাষ হয়, যে এলাকাগুলো সাধারণত বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে প্লাবিত হয়; ফলে এই সময়ে বাজারে কাঁচা মরিচের সরবরাহ হ্রাস পায়। এই কারণে প্রতি বছর এই সময়ে কাঁচা মরিচের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়।
এই বছর বর্ষা শুরুর পূর্বেই কাঁচা মরিচের মূল্য গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সন্দেহের অবকাশ আছে যে, গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিশেষ মহল কাঁচা মরিচে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নেওয়ার আয়োজনে লিপ্ত। চরাঞ্চলের চাষিদের পক্ষে কাঁচা মরিচ সংরক্ষণ সম্ভবপর নয়। তাই বর্ষা আসার পূর্বেই পণ্যটি মধ্যস্বত্বভোগীদের জিম্মায় যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এছাড়া জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বাজারে সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা স্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতস্ততা প্রকারান্তরে অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করেছেন। তবে, গত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি আরও আগে দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমদানিতে একই প্রকারের বিলম্ব করার কারণে প্রকারান্তরে সিন্ডিকেটকেই ভোক্তাদের পকেট কাটার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। কাঁচা মরিচের বেলায়ও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করা হলো কি না, সেটা অনুধাবনে কষ্ট নেই। তবে বিলম্বে আমদানি হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর ধারাবাহিক তদারকির মাধ্যমে কাঁচা মরিচের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
কাঁচা মরিচ কৃষি মন্ত্রণালয়ে আওতাধীন পণ্য হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কাঁচা মরিচ কৃষিজাত পণ্য। এর দাম কেন বেড়েছে, তা কৃষি মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত ও অনুমতি দিয়েছে। এর উৎপাদন কতটুকু হয়েছে, তা কৃষি মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে জড়িত সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা চলছে। একই বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ইতিমধ্যে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমদানিও হচ্ছে।
তাছাড়া বাজার তদারকিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তদারকি সেল মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। তারপরও বাজারে দাম বাড়ছে কেন কিংবা কারসাজি হচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থার খতিয়ে দেখা দরকার।
তবে এক মন্ত্রণালয় অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা নতুন নয়। আর এই কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি উৎসাহিত হন বলে সংশ্লিষ্ঠদের অভিমত।
কাঁচা মরিচের চাহিদার অনেকটাই দেশে উৎপাদিত হয়। কিছুটা আমদানি হয়। বৃষ্টি কিংবা চাহিদা বাড়লেই দাম বাড়তে থাকে। ঝালজাতীয় পণ্যটি এইবার দামের রেকর্ড গড়ল। এর আগে তেল, চিনি ও পেঁয়াজে একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিসহ নানা যুক্তি দেখিয়ে দফায় দফায় এইসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এইবার মরিচের বেলায়ও সেই রকম কারসাজির অভিযোগ উঠছে।
মরিচ চাষিদের সূত্র বলছে, এবার অতিরিক্ত তাপে ও খরায় মরিচ গাছ থুবড়া (কমজোরি) হয়ে গেছে। মরিচ ফুল ঝরে যাচ্ছে। আবার অতিবৃষ্টিতে কাঁচা মরিচের গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে ও ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এইসব কারণে উৎপাদন কম। অন্যদিকে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে কৃষকদের মাঠ থেকে মরিচ তোলায় বাধা পড়েছে। তাই চাহিদার তুলনায় বাজারে মরিচের সরবরাহ কম। এর বাইরে ঈদে সরকারি ছুটি পাঁচ দিন থাকায় আমদানিও কম। এইসব কারণে দাম বেড়েছে।
আমদানিতে বিলম্ব করে উচ্চ দামের এই সংকট প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে একটি মহল। যেকোনো পণ্যের সংকট হলেই দ্রুত আমদানির অনুমতি প্রদান এই সংকট সমাধানের প্রথম সমাধান। পরবর্তীতে আমদানিকৃত পণ্য দেশের সর্বত্র দ্রুত বিলিবন্টন হচ্ছে কি না তা তদারকি করা এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে। এর বাইরে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রকৃত কৃষক পর্যায়ে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
কাঁচা মরিচ সংকটকালীন সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এর তাৎক্ষণিক উদ্যোগ অনেক বেশি দরকার। তারা যদি দেখেও না দেখার ভাব নিয়ে থাকেন তাহলে সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে। কাঁচা মরিচের কেজি ৭০০-৮০০ টাকা হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এখানে অবশ্যই সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার। তাছাড়া বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির দাবি অনায়াসে মেনে নেওয়ার কারণে একেকবার একেক পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।