ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: আমাদের দেশে জ্বালানি হলো জ্বলুনি- এই সমস্যা থেকে যাচ্ছে, যাবেও। কিন্তু কতদিন? আদৌ কি এর সুরাহা হবে? হওয়ার মতো কি? এই ধরনের হা-হুতাশ বা আলোচনা আমরা শুনতেই থাকি। কয়েকদিন পত্র-পত্রিকায় এই সংক্রান্ত নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হলো- আসন্ন গ্রীষ্মে লোডশেডিংয়ের সম্ভাবনা আছে। হয়তো খুব কষ্টকর হবে না কিংবা অসহনীয় নয় কিন্তু তবু এই সম্ভাবনাই আতঙ্কজনক। বিশেষ করে যদি আপনি ব্যবসায়ীদের কথা ভাবেন, যাদের রয়েছে বড় অঙ্কের লগ্নি এবং বৃহৎ কারখানা, তারা বেশিরভাগই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করার দিকে ঝুঁকেছে।
গ্রিডে যখন গ্যাসের সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত বা র্যাশনিং করা হয়, তখনো বড় কারখানা বিপদে পড়ে যাদের সরবরাহের গ্যাস ব্যবহার করতে হয়- রাসায়নিক বিক্রিয়া বা অন্য কাজে, শুধু বিদ্যুতের কাজে নয়। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তবু তাদের বিকল্প আছে, কিন্তু প্রক্রিয়াকরণের কাজে তো বিকল্প গ্যাস তাদের নেই। যদি না তারা বিকল্প উপায়ে এলএনজি আমদানি করে। যেমন সার কারখানা।
এছাড়া, কৃষির প্রয়োজনে যে বড় সেচ পাম্পগুলো কাজে লাগে তাদের একটা বড় অংশ বিদ্যুতায়িত। বিদ্যুৎ না থাকলে তারা ডিজেল দিয়ে কাজ সারবেন। ফলে সর্বতোভাবে জ্বালানির সংকট তৈরি হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই সমস্যা কেবল নবায়নযোগ্য উৎস দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়।
ধরা যাক, আমরা বিদ্যুতের বড় অংশ নবায়নযোগ্য উৎস দিয়ে কাজ সারলাম, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে আমাদের পরিবহন খাতের বিপুল ডিজেল আমদানি করতেই হবে। অধ্যাপক ম. তামিম জানাচ্ছেন, ‘আমাদের তেলভিত্তিক বিদ্যুতের ক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াট, ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক, ৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো কয়লাভিত্তিক।’
আমদানি-নির্ভরতা আমাদের জ্বালানি-সমস্যার একটি ‘অ্যাকিলিস হিল’ সমস্যা। অধ্যাপক তামিমের ভাষ্যে, ‘মূল সমস্যা হচ্ছে, জ্বালানি সরবরাহ। এই ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়েছি। ২০১৬ সালের আগে ২০১০ সালের পরিকল্পনায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, আমাদের পরিকল্পনাটা অনেক বেশি আমদানি নির্ভর। এখন আমাদের মোট ব্যবহৃত জ্বালানির ৬৬ শতাংশই আমদানি করা। আমরা যদি নিজস্ব জ্বালানির সরবরাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করি, ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৯০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে’ (প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এই সমস্যার কখনোই সমাধান হবে না।
একটি দেশের জ্বালানি আউটলুক বিশ্লেষণে দেখতে হয়- আমাদের কী আছে, কতখানি আছে, কী পরিমাণ আমদানি করতে হবে, কোথা থেকে এবং কীভাবে। এই কয়েকটি প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলেই আমরা আমাদের জ্বালানি খাতের দর্শনটি বুঝতে পারি।
আমাদের আছে প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবহারে এর সরবরাহ কমতির দিকে। আমরা নিশ্চয় জানি প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ অসীম নয়। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে বোঝাই যাচ্ছে আমাদের আমদানির দিকেই ফিরতে হবে।
আমাদের তেলখনি নেই। কিছু কয়লা মজুদ আছে, কিন্তু উত্তোলনের আশু কোনো নীতি বা কর্মপরিকল্পনা নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের এমন বণ্টনে আমাদের জন্য যে ধরনেরই জ্বালানি কৌশল নেওয়া হোক না কেন তাতে আমদানি থাকতে বাধ্য।
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন- সবাই জ্বালানি আমদানি করে, কিছু হাতেগোনা দেশ ছাড়া। ফলে আমাদের জ্বালানি-কৌশল হওয়া উচিত কুশলী। এমন যাতে আমদানি হবে, যেহেতু তা বাস্তব, কিন্তু খরচের দিক দিয়ে তা হবে সাশ্রয়ী, একাধিক সাপ্লাই-চেইন কৌশলে ব্যবহার করতে হবে, আমাদের জ্বালানি কাঠামো এমন হবে যে তা রাশিয়ান ক্রুড বা ওমানের তেল কিংবা কাতারের এলএনজি সমান ভাবে ব্যবহারে পারদর্শী হবে, সঞ্চয়েও। বলা বাহুল্য, এটা বলা সহজ কিন্তু করা কঠিন। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার। কিন্তু সেই ধৈর্য কি আমাদের আছে?
কেননা জ্বালানি দৃশ্যকল্প দিনেরাতে বদলে যায়। দামের ওঠানামা করে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। ফলে আমাদের একটা শক্তিশালী এনার্জি ফিন্যান্স গ্রুপ দরকার যারা ভালো সিমুলেশন করে আমাদের দিকনির্দেশনা দেবে, কম্পিউটার মডেল এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি নজরে এনে তদনুযায়ী কৌশল ঠিক করা আমাদের আশু প্রয়োজন।
নবায়নযোগ্য শক্তির যে দুটো সম্ভাবনা আমাদের জন্য প্রবল- সৌর ও বায়ু, তা নিয়ে আমাদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আগে আমাদের দ্বিধা ছিল, সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা ছিল, ব্যবসায়িক উদ্যোগের অভাব ছিল। এখন এসবই বেড়েছে। ২০৪১ সাল নাগাদ বিবিধ পরিকল্পনায় (যেমন মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা) উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ‘ক্লিন এনার্জি’ বা পরিচ্ছন্ন জ্বালানি যুক্ত করার ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যে পরমাণু শক্তি অন্যতম।
‘২০১৬ সালের বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিদ্যুতের বিষয়টি উল্লেখই ছিল না। পরবর্তী সময়ে সরকার আলাদাভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ছোটখাটো লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করেছে। অষ্টম মহাপরিকল্পনায় সরকার বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে নবায়নযোগ্য থেকে। অন্যান্য পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে’ (ম তামিম, প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।
কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমস্যাগুলো এর প্রচারকেরা চেপে যান। প্রথমত, এই ধরনের উৎস সাময়িক বা ইন্টারমিটেন্ট, অর্থাৎ সবসময়ে থাকে না—সৌরালোক থেকে আপনি ভালো শক্তি পাবেন প্রায় ৪ ঘণ্টা, তাও মেঘাচ্ছন্ন দিনে তারও কম পাবেন; বাতাসের ঋতুভিত্তিক ওঠানামা আছে, আবার গ্লোবাল সার্কুলেশন বদলায়।
বাংলাদেশে সূর্যালোকের ঘনত্বও খুব বেশি নয়- গ্লোবাল হরিজন্টাল ইর্যাডিয়েন্স ৪.৫ (প্রায়), যেখানে ভারতের ৫.৫ (প্রায়)। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঝলমলে রোদ মানেই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নয়। তাছাড়া সোলারের জন্য লাগবে ব্যাটারি, তার সংশ্লিষ্ট দূষণ আছে, খরচও আছে।
সোলার হোম সিস্টেমের জন্য আনুষঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রপাতির দাম কমে গেছে, ব্যাটারির দামও পড়বে। কিন্তু এর ট্রান্সমিশন খরচ কেউ হিসাবে নেয় না। গ্রিডে যুক্ত করা, সেখানকার রিঅ্যাকটিভ লোডের সরবরাহ ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য যে খরচ দরকার তা সোলারের হিসাবে গণনা করা হয় না। এবং প্রায়শই ওই খরচটা বাদ দিয়ে প্রচারকদের বক্তব্য থাকে যে সোলার খরচ অনেক কম। ওই খরচ যোগ করলে দেখা যাবে এর দামও বাড়তি। তাছাড়া গ্রিডের সুস্থিতির প্রশ্নও আছে। এসব কারিগরি বিষয়ের সুরাহা করা দরকার।
ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা পোস্ট।