ড. কামরুল হাসান মামুন: দুটো ক্যাচি শব্দ ব্যবহার করে পুরোনো কারিকুলামে কালিমা লেপন করে নতুন শিক্ষাক্রমকে ন্যায্য বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। শব্দ দুটো হলো ‘কোচিং বাণিজ্য’ আর ‘মুখস্থ বিদ্যা’! দুইটার কোনোটির সাথে কারিকুলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
আগে বুঝতে হবে কোচিং বাণিজ্য কেন হচ্ছে? এবং বুঝতে হবে ছাত্ররা কেন মুখস্থ করে? দুটোর কারণই হলো শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর মতো হয় যোগ্য শিক্ষক নেই অথবা শিক্ষকদের কম বেতন দেওয়ার কারণে শ্রেণিকক্ষে কম পড়িয়ে এবং কম বুঝিয়ে প্রাইভেট ও কোচিং-এ পড়ার চাহিদা তৈরি করা হচ্ছে।
এই যে একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ইচ্ছে করে কম বা খারাপ পড়াচ্ছেন এর কারণ কী? আমরা কি এর কারণ খোঁজার বা বোঝার চেষ্টা করেছি? কম বা খারাপ পড়ানো বা কোচিংমুখী হওয়ার কারণে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কারণগুলো শনাক্ত করতে না পারলে বা করার চেষ্টা না করলে এর সঠিক চিকিৎসা বা নিরাময় সম্ভব না।
কোচিং বাণিজ্য হলো আমাদের স্কুল-কলেজে মানহীন শিক্ষক ও তাদের অল্প বেতন দেওয়ার ফল। যারা কারণ এবং প্রভাব বোঝে না তারাই কেবল ওই দুটো শব্দ ব্যবহার করে একটা খারাপ সিস্টেম চাপিয়ে দিতে চাইছে।
শ্রেণিকক্ষে ভালোভাবে বোঝাতে না পারা ও মানসম্মত প্রশ্ন করতে না পারার কারণ হলো মুখস্থ বিদ্যা। আর কথায় কথায় মুখস্থ বিদ্যাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করাও ঠিক না। লেখাপড়া করতে হলে কিছু জিনিস স্মরণে রাখার জন্য মুখস্থ করতে হয়। এই জন্যই মানুষের লঘুমস্তিষ্কের কাজ হলো পদ্ধতিগত স্মৃতি প্রক্রিয়া করা আর হিপ্পোক্যাম্পাস (Hippocampus) নামক আরেকটি স্থান আছে যেখানে নতুন স্মৃতি এনকোড করা হয়।
কম্পিউটারেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো মেমরি (Memory)। মনে রাখতে পারা এটা মানুষ নামক প্রাণীর বিশেষ গুণ। ভালো বেতন না দেওয়ার কারণে ভালো শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশায় আসে না, আবার আসলেও অতিরিক্ত আয়ের জন্য শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ায় না যাতে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে কিংবা তার কোচিং-এ পড়তে যায়।
এতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা অর্থ লেনদেনের ফাঁদে পড়ে। ফলে সুষ্ঠু ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। উন্নত দেশে শিক্ষকদের এমন বেতন দেওয়া হয় যাতে জীবনযাপনের জন্য সে আর প্রাইভেট কিংবা কোচিং-এ পড়ানোর চিন্তা করতে হয় না। উপরন্তু ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের বেশি বেতন দিয়ে কর্মঘণ্টা কম করা হয় যেন শিক্ষকরা পর দিনের ক্লাস পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পায়।
আমাদের দেশে শুধু স্কুল-কলেজ না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একাধিক জায়গায় পার্ট-টাইম পড়িয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করছে। যারা পার্ট-টাইম পড়াচ্ছে না তারা রাজনীতি কিংবা অন্যকোনো পথ বেছে নিয়ে মোটামুটি একটা আরামদায়ক জীবন তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু এতে বলির পাঁঠা হচ্ছে শিক্ষকরা।
বাস্তবতা হলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা ফলাফল যতটা ভালো করে এবং যতটা শিখে তার জন্য এই কোচিং সেন্টারগুলো ভূমিকা রাখছে। তার মানে কোচিংই সব নয়। কোচিং সেন্টারগুলোয় যারা পড়ায় তারা অত্যন্ত মেধাবী। এই মানের শিক্ষক যদি আমরা স্কুলে দিতে পারতাম এবং একই সাথে যথেষ্ট বেতন দিতে পারতাম তাহলে কোচিং স্বয়ংক্রিয় ভাবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ত। আমরা তা করতে পারছি না। ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে কোচিংমুখী হচ্ছে।
২০১৯ সালে ভারতে একটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। নাম সুপার ৩০ (Super 30)! চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল সত্য ঘটনা কেন্দ্র করে। আনন্দ কুমার (Anand Kumar) ছবির নায়কের নাম। তিনি ঘন ঘন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যান বিদেশি ম্যাথ জার্নাল থেকে সমস্যা খুঁজে সেইসব সমস্যা সমাধান করে গণিত শিখতে।
একদিন, লাইব্রেরির সুপারভাইজার তাকে ধরে ফেলে এবং বলে যে তার সেইখানে পড়ার অধিকার নেই। তখন সেই লাইব্রেরির একজন কর্মী পরামর্শ দেয় যে, এই জার্নালে তার নিবন্ধ প্রকাশিত হলে বিনামূল্যে আজীবন সদস্যপদ অর্জন করতে পারবেন।
আনন্দ কুমার পোস্ট অফিসে যান, যেখানে তার বাবা রাজেন্দ্র সেইখানে প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন এবং একটি কঠিন গণিত সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত একটি চিঠি পোস্ট করেন যা এখনো কেউ সমাধান করতে পারেনি।
তারপরে সমস্যা সমাধানের জন্য আনন্দ কুমার সেই জার্নালে গবেষণা প্রকাশের সুযোগ পান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ডের কাছ থেকে একটি আমন্ত্রণ পত্র পান। পরবর্তীতে অর্থের অভাব এবং পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার কারণে তার আর ইংল্যান্ডে যাওয়া হয় না। অর্থ কষ্টের সুযোগে তার এক বন্ধুর উৎসাহে একটি কোচিং সেন্টারে যোগ দেন এবং সেই কোচিং সেন্টার খুবই সুনাম অর্জন করে।
সব জায়গায় রটে যায় যে আনন্দ কুমারের কাছে পড়লে আইআইটিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আনন্দ কুমার ব্যবসায়িক কোচিং সেন্টার ছেড়ে গরিব মেধাবীদের পড়াতে থাকেন। তাদের থাকা খাওয়ারও সুযোগ করে দেন। একটি ব্যাচের ৩০ জনের মধ্যে ৩০ জনই আইআইটিতে পড়ার সুযোগ পায়।
ভারতে এমন অনেক উদাহরণ আছে। কিছুদিন আগে দক্ষিণের এক বড় বিজ্ঞানীর গল্প পড়ছিলাম। সেই বিজ্ঞানী প্রতি মাসে একবার গ্রামে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে গরিব মেধাবীদের কোচিং করান যাদের অনেকেই আজ অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী হয়েছে। এইগুলো হলো ভর্তি কোচিং।
আবার সাধারণ লেখাপড়ার কোচিংও আছে এবং সেইটা সারা পৃথিবীতেই আছে। একজন ভালো শিক্ষক কী করতে পারেন তার উদাহরণ এই আনন্দ কুমার। সেই জায়গা থেকে চিন্তা করলে আমাদের অবস্থান কোথায় তা জানা এবং বোঝা যায়। সরকারের উচিত স্কুলে আরও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো।
দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথা না বললেই নয়। কেজরিওয়াল সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন মানের তৈরি করেছেন যে, এখন দিল্লির মানুষ প্রাইভেট স্কুল থেকে তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি বা পাবলিক স্কুলে ভর্তি করাচ্ছে। দিল্লির সরকার কি আইন করে প্রাইভেট ব্যবসায়িক স্কুল বন্ধ করেছে? তা করার দরকার নেই।
সরকারের উচিত আগে অগ্রাধিকার ঠিক করা। অগ্রাধিকার হলো ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া, শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের রাজনীতির গুটি হিসেবে ব্যবহার না করা। আর এইসব শুরু হতে পারে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে।
সরকার এক দিকে শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা বলছে আর অন্য দিকে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমাচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্যই তো ভালো না। পুরো শিক্ষকতা পেশায় রাজনীতির বিষবাস্প ঢুকিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপিরা শিক্ষকদের ক্ষমতা দেখায়, অপমান করে। তাহলে শিক্ষার মান কীভাবে ভালো হবে? সমস্যা হলো স্কুলের শিক্ষকরা যেন কোচিং-প্রাইভেট না পড়ায়, তা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের যথেষ্ট বেতন ও মর্যাদা দিতে হবে। তাদের গরিব বানিয়ে রাখবেন আর বলবেন বিশ্বমানের লেখাপড়া করাবেন তা কি হয়?
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ তার প্রয়োজনেই পথ খুঁজে নেই, শিক্ষকরাও তাই করেছেন। আজকের সমাজের যত সমস্যা তার মূল এখানেই নিহিত আছে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।