ফুরকানুল আলম: শিল্পায়ন দেশে দেশে এনেছে সমৃদ্ধি-সচ্ছলতা। জীবনযাত্রা করেছে সহজ। তবে, সাথে নিয়ে এসেছে প্রাকৃতিক অভিশাপ। যার একটি তাপমাত্রা বৃদ্ধি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা। যাতে হিমবাহ গলে বাড়ছে সাগর পৃষ্ঠের উষ্ণতা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বন্যার সাথে দেখা দিচ্ছে দাবানল। প্রাকৃতিক এ সব দুর্যোগের শিকার ধনী-গরিব সব দেশ।
উল্লেখ্য, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পাললিক শিলার বিভিন্ন স্তরে আবদ্ধ হয়ে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণির দেহাবশেষ ভূগর্ভের তাপ, চাপ ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে এবং বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যেসব জ্বালানির সৃষ্টি করে, তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি বলে। যেমন- কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস।
এজন্য শিল্প বিপ্লবের আগের চেয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অন্তত দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চিন্তা করা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে এ বিষয়ক একটি মাইলফলকে সম্মত হয় সব দেশ। কিন্তু, এটি বাস্তবায়নে যে সব কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে আর একমত হতে পারে বিশ্ব। যাতে নতুন এক শঙ্কা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, উষ্ণতম বছরের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে চলতি বছর। তাপমাত্রা এই বৃদ্ধি কমার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না।
যাতে ২০২৭ সালের মধ্যেই শিল্পায়নের যুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করতে পারে। মানুষের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন হচ্ছে এবং চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা দেখছেন সেটি থেকেই এমন আশঙ্কা জানিছেন তারা। একে ভয়াবহ উদ্বেগের বিষয় বলছেন বিজ্ঞানীরা।
উন্নত দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, সৌদি আরব এমনকি আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতও জীবাশ্ম জ্বালানি পুরোপুরি বন্ধে রাজি নয়। কমানোর প্রশ্নেও রয়েছে নানা গড়িমসি। এই তালিকায় সবচেয়ে কৌতূহল জাগানো দেশ জাপান। কারণ সভ্যতা আর মানবতাবোধের নানা উদাহরণের কারণে দেশটি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর আলাদা ধারণা রয়েছে। এমন একটি দেশ কেন বিশ্বের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকারক জ্বীবাশ্ম জ্বালানির বিপক্ষে সরব তো নয়ই, উল্টো নানাভাবে পক্ষে কাজ করে। তা হয়তো অনেককেই বিস্মিত করতে পারে।
আসল ব্যাপার হলো, ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয়ের পর জাপানের জ্বালানি চাহিদার সিংহভাগই জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর হয়ে গেছে। বিশ্বে এই জ্বালানি ব্যবহাকারীদের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ৫ নম্বরে রয়েছে জাপানের নাম। রাতারাতি এই ব্যবস্থা থেকে বের হতে পারবে না তারা। এ জন্য দরকার দীর্ঘ বিনিয়োগ।
শীর্ষ উৎপাদকের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের তালিকাতে উপরের দিকের দেশ সৌদি আরব। তেল-গ্যাস-কয়লার ওপর যার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে; তারা কীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের প্রকল্পে একমত হবে। এক্ষেত্রে তারই প্রতিবেশি সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তারা অনেক আগে থেকেই তেল কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বহুমুখিকরণে হাত দিয়েছে। যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় একটি কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে দুবাইকে।
এছাড়া, পর্যটনসহ আনুষঙ্গিক উপাদানকে বেশ ভালোভাবে বিশ্বের দুয়ারে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে শিক্ষা বাণিজ্য। যদিও ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় এটি এখনও শৈশব পার করছে। সৌদি আরবও যে একরকম বসে আছে। তা নয়, ধীরে ধীরে তারও চেষ্টা করছে। কিন্তু দেরিতে শুরু করায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের তুলনায় রিয়াদ এখনও যোজন যোজন দূরে রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনতে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার, একই সাথে এই জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে বহুমুখি হতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা জরুরি। নইলে, উত্তাল সাগরে ঝড়ের মাঝে যেমন জাহাজের কোনো তলার মানুষই নিরাপদ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপদ পড়বে সবাই।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল 24।
সৌজন্যে, জাগোনিউজ।