ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: কোরবানি ঈদের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের প্রভাব বাজারে তেমন পড়ছে না বলে মনে করছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। লাগামহীন পণ্যমূল্যে দিশেহারা ও অসহায় হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্দেশ্যে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরেছে সংগঠনটি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘ঈদকে সামনে রেখে পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি এবং ভোক্তা স্বার্থের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ক্যাব।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া।
এছাড়াও, সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম, সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইনসহ ক্যাবের জেলা কমিটির সদস্যরা।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘দেশের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং করোনা পরবর্তী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এটা অর্ধেক সত্য। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তার মধ্যে সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট পলিসি নিয়ন্ত্রণে নেওয়াকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এমনটি করা হয়নি। আমাদের এখানে কি হচ্ছে, গত ১১ মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই টাকা কোথা থেকে দিল? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকশাল আছে। টাকশাল থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তার প্রভাব বাজারে এসে পাঁচগুন হয়। অর্থাৎ অর্থ সরবরাহ পাঁচগুন বেড়ে যায়। ৭০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ তিন লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা অর্থ বাজারে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেটের ঘাটতি মেটানো মূল্যস্ফীতির একটা বড় কারণ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ২০২০ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেটকে নয় ছয়ের বাধনে বেধে দেওয়া হয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম টানার যে হাতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ছিল তা ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।’
গোলাম রহমান বলেন, ‘যেসব পণ্য সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি হিসেব করে তার সবগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ৫০ থেকে ৬০টি পণ্য। তাই ৫০-৬০টি পণ্য জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এসব পণ্য নিয়ে যদি ইনডেক্স করা যেত হয়তো দেখা যেত মুদ্রাস্ফীতি যেটা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন তার পরিমাণ অনেক বেশি হতো।’
তিনি বলেন, ‘টিসিবির যে বাজার দর সেটা যদি পর্যবেক্ষণ করেন দেখবেন গত এক বছরে অনেক পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার প্রতিফলন ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ইনডেক্সে সঠিক ভাবে হচ্ছে বলে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।’
নিত্যপণ্যের বাজার সরকারের সংস্থাগুলোর তদারকি আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান যে প্রশাসনিক কাঠামো, সেটাকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুটো ডিভিশন থাকা উচিৎ। একটা কনজুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন অন্যটি বিজনেস ডিভিশন। যেসব বড় বড় কাজ যেমন- আমদানি রপ্তানি এগুলো বিজনেস ডিভিশন দেখবে। ভোক্তাদের স্বার্থ দেখবে কনজুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ভোক্তার স্বার্থকে প্রথমে দেখেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব সংস্থার সঙ্গে ভোক্তা স্বার্থ জড়িত। এসব সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় করে ভোক্তাবান্ধব করার একটা সুযোগ আছে। সেটি এখন হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না। তাই আমরা চাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কনজুমারস অ্যাফেয়ার্স নামে একটা আলাদা ডিভিশন। এখন যে এক কোটি মানুষকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে অর্থাৎ পাবলিক ডিসট্রিবিউশন, এটাও এই ডিভিশনের আওতায় থাকবে। এই ডিভিশন ভোক্তা স্বার্থ দেখবে।’
লিখিত বক্তব্যে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঈদের এক মাস আগে থেকেই পণ্যমূল্যের বাজার অস্থিতিশীল। কোরবানি ঈদের আগে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, জিরাসহ অন্যান্য মসলাপাতির দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ শুরু করলেও বাজারে তার প্রভাব তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তারা লাগামহীন পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা ও অসহায়। সরকারকে এখনই তৎপর হতে হবে ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তেলের দাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ১০ টাকা কমিয়েছে সরকার। তবে তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। নতুন দাম নির্ধারণ হওয়ার এক সপ্তাহ পরও ঢাকার খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮৯ টাকার স্থলে ১৯০-১৯৫ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৬৭ টাকার স্থলে ১৭৫-১৮৫ টাকা ও পাম তেল ১৩৩ টাকার স্থলে ১৩৫-১৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কতিপয় ব্যবসায়ী ভোক্তাদের নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন। এতে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তা।’
পেঁয়াজ, রসুন, জিরা বাজার নিয়ে হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, ‘তিন মাস আগে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫-৪৫ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। তবে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেবার পর এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরের তুলনায় দেশি রসুনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৩ শতাংশেরও অধিক। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি জিরা ৮০০-৮৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিন মাস আগে যা ছিল ৫৮০-৬৫০ টাকা। আবার এক বছর আগে এই সময়ে ছিল প্রতি কেজি গড়ে ৪৮০ টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে ৫৬ শতাংশের অধিক দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সরকারের নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে খুচরা বাজারে খোলা চিনি ১৩০-১৪০ টাকায় ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখন আবারও ২৫ টাকা চিনির দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে চিনিকল মালিকরা।’
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ক্যাব চিনিকল মালিকদের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, ভোক্তা স্বার্থবিরোধী ও অন্যায় বলে মনে করে। ক্যাব ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে। ক্যাব আশা করে সরকার ভোক্তাদের অবস্থা চিন্তা করে চিনিকল মালিকদের সংগঠনের এই মুনাফালোভী সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামেই খুচরা বাজারে খোলা চিনি ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ করবে।’
ভারত থেকে গরু আমদানির সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের বাজারে গরুর মাংস ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ভারতের কলকাতায় গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬০ রুপিতে যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৪৫ টাকা। প্রতি বছর কোরবানির গরুর দাম অত্যধিক থাকে। কম দামে গরু পেতে ভারত থেকে কিছু গরু আমদানি করা যেতে পারে।’
লাগামহীন বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্দেশ্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশসমূহ হলো-
১. পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যের বিক্রয়মূল্য দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করার জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও প্রাপ্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি মূল্য, পাইকারি মূল্য ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে ও তা বাস্তবায়নের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুদকারীদের জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে ও তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৫. পেঁয়াজ, রসুন, আদার অধিকতর চাষাবাদের জন্য বীজ, সার ও লাগসই আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের নিকট সহজলভ্য করতে হবে।
৬. সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে সরিষার অধিকতর চাষাবাদের ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া রাইস ব্র্যান অয়েলের সুলভ মূল্যে উৎপাদন ও ব্যবহার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭. প্রাণিজ পুষ্টির চাহিদা পূরণে গরুর মাংস সহজলভ্য করার জন্য খামারিদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
৮. পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়ে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ দিতে হবে। পণ্য আমদানির পর তা যেন নির্দিষ্ট দামে বাজারে বিক্রি হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. সম্প্রতি চিনির দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত চিনিকল মালিকদের সংগঠন গ্রহণ করেছে তা কার্যকর না করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামেই খুচরা বাজারে খোলা চিনি ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১০. বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করার জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহকে যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১. সড়কে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন হয়রানি বন্ধ করার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. আমদানিকৃত পচনশীল পণ্য স্থল ও নৌ বন্দর থেকে দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
-এসআর