ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঈদের এক মাস আগে থেকেই পণ্যমূল্যের বাজার অস্থিতিশীল। কোরবানি ঈদের আগে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, জিরাসহ অন্যান্য মসলাপাতির দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ শুরু করলেও বাজারে তার প্রভাব তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তারা লাগামহীন পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা ও অসহায়। সরকারকে এখনই তৎপর হতে হবে ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিম্নে নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের বাজারের অবস্থা তুলে ধরা হলো।
ভোজ্যতেল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র দুই দশমিক ০৩ লাখ মে. টন। অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল প্রতি বছর আমদানি করতে হয়। জুলাই ২০২২ থেকে মে ২০২৩ পর্যন্ত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে প্রায় ১৯ দশমিক ৩২ লাখ মে. টন। গত বছর সয়াবিন বীজের আমদানি হয়েছে প্রায় সাত লাখ ১৪ হাজার মে. টন।
২০২৩ সালের ১১ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ১০ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় ১৮৯ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৭ টাকা। পাম তেলের দাম লিটারে দুই টাকা কমিয়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। বাণিজ্য সচিব সে সময় আশ্বাস দিয়েছিলেন আগামী তিন দিনের মধ্যে ভোক্তারা এই দামে তেল পাবেন বাজারে। কিন্তু নতুন দাম নির্ধারণ হওয়ার এক সপ্তাহ পর ২০২৩ সালের ১৭ জুন ঢাকার খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮৯ টাকার স্থলে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। খোলা সয়াবিন এখন ১৬৭ টাকার স্থলে ১৭৫-১৮৫ টাকা ও পাম তেল ১৩৩ টাকার স্থলে ১৩৫-১৪৫ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত সভায় খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সরকার ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির জন্য। কিন্তু রিফাইনারি ও ডিলার পর্যায়ে বিক্রির দর ঠিক করা হয়নি। ফলে খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি দামে ডিলারদের নিকট থেকে ভোজ্যতেল কিনতে হচ্ছে। তাই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে তাদের ভোজ্যতেল বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে ভোক্তারা বেশি দামে সয়াবিন তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ কারণে কতিপয় ব্যবসায়ী ভোক্তাদের নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন। সম্প্রতি সরকার সয়াবিনের আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য সারাদেশে সরিষা চাষের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
পেঁয়াজ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছরে দুই লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হয় আর উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ মে. টন। দেশে প্রায় ২৮ লাখ মে. টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। যদিও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৫০ লাখ মে. টন। সংরক্ষণকালে ও প্রক্রিয়াজাতকালে ৩৫ শতাংশের মতো পেঁয়াজ নষ্ট হয়। সে হিসাবে দেখা যায়, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার বড় একটি ঘাটতি রয়েছে।
ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজারের ক্যাবের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিন মাস আগে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫-৪৫ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য সরকার গত ০৬ মার্চ পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়ায় পেঁয়াজ এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আর পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকায়। ঢাকার শ্যামনগর পাইকারি বাজারে ভারত থেকে আমাদিনকৃত পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩৩-৩৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে ৪৫-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
চিনি
দেশে প্রায় ২০ লাখ মে. টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা আছে। জুলাই ২০২২ থেকে মে ২০২৩ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৬৭ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে অর্থাৎ দেশের চাহিদার তুলনায় সিংহ ভাগ চিনি আমদানি করতে হয়। গত ১০ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় খোলা চিনি প্রতি কেজি ১২০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।
ক্যাবের বাজার দর সংগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে খুচরা বাজারে খোলা চিনি ১৩০-১৪০ টাকায় ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের নির্ধারিত দামে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে না। গত বছর খোলা চিনি প্রতি কেজিতে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ গত ০১ বছরে খোলা চিনির মূল্য ৫৭ শতাংশের অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
খুচরা বাজারের প্রতিনিধিরা জানান, পাইকারি বাজার থেকে তাদের অধিক দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। সরকার খুচরা বাজারের মূল্য নির্ধারণ করেছে আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ের মূল্য নির্ধারণ করেনি। ফলে খুচরা ব্যবসায়ীদের সরকারের নির্ধারিত দামের অধিক দামে বাজারে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় গত ১৯ জুন চিনিকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফানার্স এসোসিয়েশন চিনির দাম প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কথা বাংলাদেশ সুগার রিফানার্স এসোসিয়েশন চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনকে জানিয়েছে যা ২২ জুন থেকে কার্যকর হবার কথা। ক্যাব চিনিকল মালিকদের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, ভোক্তা-স্বার্থ বিরোধী ও অন্যায় বলে মনে করে। ক্যাব ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে। ক্যাব আশা করে সরকার ভোক্তাদের অবস্থা চিন্তা করে চিনিকল মালিকদের সংগঠনের এই মুনাফালোভী সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামেই খুচরা বাজারে খোলা চিনি ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ করবেন।
রসুন
ঢাকার খুচরা বাজারে বর্তমানে দেশি রসুন ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন মাস আগেও যা খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ১০০-১৫০ টাকায়। গত এক বছরের তুলনায় দেশি রসুনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৩ শতাংশেরও অধিক।
জিরা
বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি জিরা ৮০০-৮৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিন মাস আগে যা ছিল ৫৮০-৬৫০ টাকা। আবার এক বছর আগে এই সময়ে ছিল প্রতি কেজি গড়ে ৪৮০ টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে ৫৬ শতাংশের অধিক দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
গরুর মাংস
দেশের বাজারে গরুর মাংস ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ভারতের কলকাতায় গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬০ রুপিতে যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৪৫ টাকা। ভারতে প্রচুর গরু উৎপাদন করা হয় কিন্তু ধর্মীয় কারণে তারা গরুর মাংস খান না। ফলে ভারতে চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হওয়ার কারণে দাম কম। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি বলে এখানে গরুর মাংসের দাম বেশি। অর্থাৎ ভারতের তুলনায় প্রতি কেজিতে প্রায় ৪৫৫ টাকা থেকে ৫০৫ টাকা বেশি। বাংলাদেশে অতিরিক্ত গরুর মাংসের চাহিদার কারণে এতো দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চড়া দামের কারণে নিম্নবিত্ত লোকেরা এখন গরুর মাংস খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। মাঝারি আয়ের সংসারের রান্নাঘরে গরুর মাংস এখন মাঝে মধ্যে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতি বছর কোরবানির গরুর দাম অত্যধিক থাকে। এর কারণ হিসেবে গরুর খামারিরা বলেন, গরু লালন-পালনে খরচ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গো-খাদ্যসহ অন্যান্য খরচ অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গরুর উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৪৭ লাখ। এছাড়া কোরবানিকে উপলক্ষ রেখে বিভিন্ন খামারে ও ব্যক্তিগত ভাবে অনেক খামারিরা গরু উৎপাদন করে থাকে। আবার দেশীয় গরুর খামার ও চামড়া রক্ষার স্বার্থে সরকার ভারতীয় গরু আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ফলে দেশীয় বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগানের ঘাটতির কারণে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে বলে গরু ব্যবসায়ীরা জানান।
সুপারিশসমূহ:
১. পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যের বিক্রয়মূল্য দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করার জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও প্রাপ্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি মূল্য, পাইকারি মূল্য ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে ও তা বাস্তবায়নের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুদকারীদের জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে ও তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৫. পেঁয়াজ, রসুন, আদার অধিকতর চাষাবাদের জন্য বীজ, সার ও লাগসই আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের নিকট সহজলভ্য করতে হবে।
৬. সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে সরিষার অধিকতর চাষাবাদের ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া রাইস ব্র্যান অয়েলের সুলভ মূল্যে উৎপাদন ও ব্যবহার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭. প্রাণিজ পুষ্টির চাহিদা পূরণে গরুর মাংস সহজলভ্য করার জন্য খামারিদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
৮. পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়ে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ দিতে হবে। পণ্য আমদানির পর তা যেন নির্দিষ্ট দামে বাজারে বিক্রি হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. সম্প্রতি চিনির দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত চিনিকল মালিকদের সংগঠন গ্রহণ করেছে তা কার্যকর না করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামেই খুচরা বাজারে খোলা চিনি ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১০. বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করার জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহকে যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১. সড়কে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন হয়রানি বন্ধ করার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. আমদানিকৃত পচনশীল পণ্য স্থল ও নৌ বন্দর থেকে দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
-এসআর