ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: আসন্ন রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সঠিকভাবে পেলে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। তবে আমদানিকারক, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরবরাহকারীরা যদি বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করে তাহলে আসন্ন রমজানে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। বাজার স্বাভাবিক থাকবে।
রোববার সকালে রাজধানীর টিসিবি অডিটরিয়ামে আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে অংশীজন এবং ঢাকা সিটির অধীন সকল বাজারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অংশগ্রহণে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান, এফবিসিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আরিফুল হাসান, পি.এস.সি, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রমূখ। এছাড়া আমদানিকারকসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ী নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সভায় পাইকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা সীমিত লাভে ব্যবসা করি। কিন্তু সরকারের যেসব সংস্থা অভিযান চালায় তারা খুচরা বাজারে গিয়ে জরিমানা করে। তারা যদি বড় বড় কোম্পানি, সরবরাহকারী এবং মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তাহলে বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকবে। কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। ভোক্তারা ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারবে।
সভায় আমদানিকারকদের মধ্যে ওয়েল এসোসিয়েশন এবং সুগার এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে পর্যাপ্ত পণ্য মজুত রয়েছে। বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি হবে না।
ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, আসন্ন রমজানে আমরা সকল ব্যবসায়ী লাভ কম করবো। ভোক্তারা যাতে ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবো। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকলে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিবে সেই দাম প্রত্যেক দোকানে টানিয়ে রাখা হবে। যাতে কোনোভাবেই ভোক্তারা প্রতারিত না হয় এবং ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নিতে না পারে।
এফবিসিসিআই এর সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, অস্বাভাবিক কিছু কাজের জন্য সবাইকে ব্লেম নিতে হয়। দুই-একজন অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য সবার সুনাম নষ্ট হয়।
তিনি বলেন, রমজান আসলে বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনেক জিনিসের দাম কমানো হয়। অনেক জিনিসপত্রের বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটার উল্টোটা দেখা যায়। আমরাও এবার রমজানে সেই ধরনের কালচার তৈরি করতে চাই। এটা চাইলেই সম্ভব।
কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। যে প্রতিযোগিতা আছে সেটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও সোচ্চার হতে হবে। বাজারে যদি সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে তবে পণ্যের মান ভালো হয়। ব্যবসায়ী-বিক্রেতা-ভোক্তা সবাই লাভবান হয়।
গোলাম রহমান বলেন, আমাদের ভোক্তাদের একটা সমস্যা হলো রমজান বা কোনো ক্রাইসিস সময় হলে একসঙ্গে অনেক জিনিস কিনে রাখে। অনেক সময় অপচয়ও করে। এতে বাজার আরও সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। এই জিনিসটা বন্ধ করতে হবে।
সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, রমজানে মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকে। আমরা সবসময় দেখি ব্লেইম গেম। পাইকাররা বলে রিটেইলাররা বেশি নিচ্ছে। আবার রিটেইলাররা বলে পাইবাররা বেশি নিচ্ছে। একজন আরেকজনের উপর দোষ চাপাচ্ছে। তাহলে কে সঠিক? এক সাথে তো সবাই সঠিক হতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই এই দৃশ্য দেখে আসছি। তাহলে নিশ্চয় এর মধ্য থেকে কেউ সুযোগ নিচ্ছেন। এই বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের এই সিনিয়র সচিব বলেন, বাজার অর্থনীতিতে সব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। তবে বাজার অর্থনীতির একটি নিয়ম রয়েছে। পণ্যের দাম, খরচ এবং লাভ মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করতে হয়। তবে যখন দেখি বাজার অর্থনীতির সঙ্গে দামের মিল থাকে না তখন সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। আপনারা সঠিক নিয়মে ব্যবসা করলে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। ১৭ কোটি মানুষের লাখ লাখ ব্যবসায়ী। প্রত্যেক লোককে পাহারা দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সবাইকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা যে প্রাইস নির্ধারণ করে দেব, সেটা মানতে হবে।
বাজার মনিটরিং এর বিষয়ে তিনি বলেন, বাজার মনিটরিং এ গিয়ে যে শুধু শাস্তি দিবে তা নয়। বাজার পরিস্থিতি সঠিকভাবে চলছে কি না সেটি দেখবে। কাউকে শাস্তি দেওয়া কারো উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাজার না চললে তখন শাস্তির আওতায় আনা হয়।
গরুর মাংস ও ডিম আমদানি ওপেন করে দিলে এসবের দাম কমবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু বৃহৎ স্বার্থে এসব আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন যদি গরু আমদানি করা হয় তবে খামারিরা বিপদে পড়বে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই বিষয়গুলাও দেখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আসন্ন রমজান উপলক্ষে চিনি, তেল ও ছোলা, ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। রমজানে ঘাটতি হওয়ার সুযোগ নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করে যে, রমজান আসলেই দাম বাড়ে। এই বিষয়টা বাজারকে উস্কে দেয়। আবার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে রিফাইনারি, পাইকারি, রিটেইলার ব্যবসায়ীরা একে-অপরকে দোষারোপ করে। এই বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, এবার রমজানে কোনো বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে বাজার কমিটিকে দায়ী করব। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করবো যাতে সেই কমিটি ভেঙ্গে দেয়।
তিনি বলেন, পণ্যের কোনো ঘাতটি নেই, উৎপাদনে ঘাটতি নেই, কিন্তু বাজারে সংকট তৈরি হবে কেন?
বাজার মনিটরিং এর বিষয়ে সফিকুজ্জামান জানান, এবার বাজার মনিটরিংয়ে সারাদেশে আমাদের ৫০টি টিম কাজ করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৪টিম কাজ করবে। এছাড়াও দোকান মালিক সমিতি, বাজার কমিটিও মনিটরিং করবে।