ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট : ‘ভোক্তা-অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার সুফল’ নিয়ে ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে (এফডিসি) জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র যৌথ ভাবে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালকগণ, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকগণসহ বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ তাঁর বক্তব্যের শুরুতে শোকের মাস অগাস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সকল সদস্যদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযানের পাশাপাশি ভোক্তা সাধারণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন অন্যতম। দুই দলের বিতার্কিকদের বক্তব্য শুনে আমি অভিভূত। তরুণ প্রজন্মের এই শিক্ষার্থীদের দ্বারাই বাস্তবায়ন হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
ক্ষেত্র বিশেষে সময়ে সময়ে দেশে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের পাশাপাশি আমদানিকৃত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানসহ পণ্যের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন তপন কান্তি ঘোষ।
তিনি বলেন, সরকার দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ও খামারীদের স্বার্থ বিবেচনায় সময়ে সময়ে কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ভোক্তা স্বার্থ বিবেচনায় আবার সে সকল পণ্য আমদানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। দেশের বাজার ব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার পলিসি গ্রহণ করে।
তিনি প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত এ বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ অন্যান্য জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতন হবে ভোক্তা এবং সুরক্ষিত হবে ভোক্তার অধিকার এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক ডাবের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়৷ গভীর রাতে অভিযান করেও আজ সকালে অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তাগণ এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে।
তিনি বলেন, অভিযানে ক্ষেত্র বিশেষে অধিদপ্তর একা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে সাথে যৌথ ভাবে অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
তিনি আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষত সয়াবিন তেল ও চিনির মূল্য (যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়) স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে অধিদপ্তর কর্তৃক রিফাইনারি থেকে পরিবেশক পর্যায় পর্যন্ত তেল ও চিনির মজুদ পরিস্থিতি জানার লক্ষ্যে একটি অ্যাপস তৈরির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মাধ্যমে এ সকল পণ্যের অবৈধ মজুদ শনাক্ত করা সহজ হবে এবং এর সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অধিদপ্তর কর্তৃক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।
এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অধিদপ্তর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন ভোক্তাদের সচেতনতা। ভোক্তারা যতদিন পর্যন্ত তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হবে ততদিন পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অধিদপ্তরের কাজের মূল্যায়ন এবং ক্ষেত্র বিশেষে সমালোচনা করা হবে। আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সমালোচনাকে স্বাগত জানাব এবং তা নোট করে প্রয়োজন সাপেক্ষে অধিদপ্তরের কার্যক্রম সংশোধন করা হবে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ এবং প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে অধিদপ্তর যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে ও ভোক্তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছে।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ভোক্তা-অধিকার আদায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সমন্বিত ভাবে আরও জোরদার করা সম্ভব হলে জনগণ এর সুফল আরও বেশি পাবে। চিনি, ভোজ্যতেল, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম প্রায়শই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। দামের উত্থান-পতনের পেছনে সাপ্লাই চেইনের দুর্বলতা বড় একটা কারণ। পণ্যের উৎপাদক অর্থাৎ কৃষক পর্যায় থেকে শুরু করে আড়ৎদার, ফড়িয়া, পাইকার, খুচরা পর্যায় হয়ে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর পুরো নেটওয়ার্কে সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। এসব প্রতিরোধে আরও শক্তিশালী বাজার মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে।
তিনি বলেন, তবে এখনো পর্যন্ত ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে যে অভিযান চালিয়েছে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। আমি সরকারের কাছে সুপারিশ করছি যদি সম্ভব হয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে অভিযান পরিচালনাকারী সৎ কর্মকর্তাকে যেন সরকারি ভাবে পুরস্কৃত করা হয় যাতে অভিযান পরিচালনাকারীরা তাদের অভিযান পরিচালনায় আরও বেশি উৎসাহ পায়।
তিনি বলেন, মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেছি। মিঠা পানির মাছে আমরা পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে যেতে পেরেছি। এছাড়াও ছোট বড় মিলিয়ে দেশে অনেক মৎস খামার গড়ে উঠেছে। পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, কই, পাবদা, রুই, কাতলা উৎপাদনও যথেষ্ট। তারপরও পাঙ্গাসসহ অন্যান্য চাষের মাছের দামও এখন বেশ চড়া। ডিম ও ব্রয়লার ওপর নিম্ন মধ্য আয়ের মানুষ আমিষের চাহিদা মেটাতেও এখন হিমশিম খাচ্ছে। ডিম ও ব্রয়লার মুরগির বাজার কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও, প্রায়শই অস্থির হয়ে যায়। রসুন, আদা, সবজির দামও বাড়তি। অভ্যন্তরীন বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ কর আরোপ করায় বাংলাদেশের বাজারেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। অন্যদিকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবে দেশের প্রান্তিক ডেইরী ফার্ম, পোল্ট্রি খামারসহ এগ্রোফার্মিংয়ের সাথে জড়িত অনেকেই পুঁজি হারাচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানীগুলোর কন্ট্রাক্ট ফর্মিংয়ের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে এসব প্রান্তিক খামারিরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভোক্তা-অধিকার আইনকে শক্তিশালী করা, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকা, পণ্যের সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করা, সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখা, বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার করাসহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। একইসাথে মূল্য বৃদ্ধি কারসাজির সাথে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ সরকারি দল হিসেবে বিষয়ের পক্ষে ও তেজগাঁও কলেজ বিরোধী দল হিসেবে বিষয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করেন। তেজগাঁও কলেজ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়।
প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, প্রফেশনাল একাউন্টেন্ট আবুল বশির খান, সাংবাদিক সায়েদুল ইসলাম, সাংবাদিক অনিমেষ কর ও যুগ্ম কর কমিশনার মেহেদী হাসান তামিম।
প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
-এসআর