ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশে যেকোনো খাদ্যশস্যের ব্যবসা করতে হলে ফুড গ্রেইন লাইসেন্স লাগে। খুচরা ব্যবসায়ী থেকে মিল মালিক পর্যন্ত সরকারি ভাবে এ লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। মজুতদার ও আমদানিকারকরাও এ লাইসেন্সের অন্তর্ভুক্ত। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়নসহ রয়েছে আরও নানা নিয়ম। ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে একেবারেই আগ্রহী নন। এমনকি তারা সঠিক তথ্য দিতেও গড়িমসি করেন। তবে এ বিষয়ে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার।
আইন অনুযায়ী, ফুড গ্রেইন লাইসেন্সধারীদের আমদানি, মজুত ও ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব পাক্ষিকভিত্তিতে খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এ লাইসেন্স নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। নানা সুযোগ ও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও লাইসেন্স করার ক্ষেত্রে মিলছে না প্রত্যাশিত সাড়া।
জানা যায়, একক কিংবা মিলিতভাবে এক টনের বেশি ধান, চাল, গম, গমজাত দ্রব্য, ভোজ্যতেল (পরিশোধিত সয়াবিন ও পামঅয়েল), চিনি এবং ডালের ক্ষেত্রে এ লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। সরকার ‘The Control of Essential Commodities Act, 1956 (Act No. 1 of 1956)’ এ ফুড গ্রেইন লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী, সারাদেশে এ লাইসেন্স কতসংখ্যক ব্যবসায়ীর জন্য বাধ্যতামূলক সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ এ ধরনের ব্যবসা কতজন করেন সে সংখ্যা অজানা। তবে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা যায় এর সংখ্যা কয়েক লাখ। আর খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারাদেশে ফুড গ্রেইন লাইসেন্সধারীর সংখ্যা মাত্র ৫২ হাজার। আবার ওইসব লাইসেন্সধারীর মধ্যে একটি বড় অংশ নিয়মিত তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেন না। এছাড়া অধিকাংশই আমদানি, মজুত, ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য দেন না নিয়মিত।
সার্বিক বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বারবার তাগিদ ও প্রচারণা করেও অনেকে লাইসেন্স নিচ্ছেন না। যদিও লাইসেন্স নেওয়ার প্রবণতা এখন অনেকটা বেড়েছে। আবার পাক্ষিক তথ্য পাওয়া যায় না। মাসিক তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তারপরেও অনেকে হালনাগাদ তথ্য দেন না।’
রামপুরার বউবাজারে আবুল হাসেম চালের ব্যবসা করেন। তার ফুড গ্রেইন লাইসেন্স নেই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসার জন্য আলাদা কোনো লাইসেন্স প্রয়োজন হয় সেটা জানা নেই। এ বিষয়ে সরকারের কেউ কখনো তাগাদা দেয়নি। দেখতেও চাওয়া হয়নি কখনো। লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসার সব কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলছে।’
বড় ব্যবসায়ী যারা মিলার কিংবা সরবরাহকারী তাদের অধিকাংশের এ লাইসেন্স রয়েছে। তবে তারা বাড়তি ঝামেলা এড়াতে নিয়মিত তথ্য দেন না। অনেকে তাদের মজুত ও বিক্রির তথ্য জানাতে চান না। কারণ তারা মনে করেন, সরকারের কাছে বেশি মজুত বা বিক্রির তথ্য থাকলে তারা ঝামেলায় পড়বেন।
কুষ্টিয়ার একজন চালকল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এসব তথ্য দিলে সমস্যা হতে পারে। ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে সমস্যা। আবার ফুড ইন্সপেক্টরের ঝামেলা আছে। যারা দেয়, তারা দায়সারা একটি প্রতিবেদন দেয়। যেটা বাস্তবিক মজুত বা বিক্রির সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। দিতে হবে তাই দেয়। কিন্তু আমি দেই না।’
খাদ্যপণ্যের পুরোনো ব্যবসায়ী নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকে অলসতা করে দেয় না। কেউ দেয় না নিজেদের ব্যবসায়িক গোমর ফাঁস হবে সে ভয়ে। আবার কেউ একটা প্রতিবেদন দেয়, যার বাস্তব মজুত বা বিক্রির সঙ্গে কোনো মিল নেই।’
তথ্য দেওয়ার ভয়ে লাইসেন্স নেন না অনেকে
সরকারকে আমদানি, মজুত, ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব পাক্ষিকভিত্তিতে দিতে হবে- এ ভয়ে অনেকে লাইসেন্স নেন না। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের লাইসেন্স না নেওয়ার কারণ হিসেবে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
বাবুবাজারের পুরোনো ব্যবসায়ী, চাল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা ও বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কাওসার আলম খান বলেন, ‘এ লাইসেন্স ছাড়াও ব্যবসায়িক সব কার্যক্রম চলছে। তাহলে অহেতুক কেন ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স নিয়ে সরকারকে নিয়মিত টাকা ও নিজের সব তথ্য দেবে? তাহলে অনেক মিলমালিকসহ বড় বড় মজুতদারের তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আবার কেউ মনে করেন, যাদের নেই তারা ব্যবসা করছে, কেন আমি এত টাকা খরচ করবো। এ লাইসেন্স প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। বছর বছর খরচ আছে। যদিও তা খুব বেশি নয়।’
লাইসেন্স পেতে আছে হয়রানি
খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত ফরমে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরাবর এ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবেন। এরপর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর আবেদনকারীর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করবেন। পরবর্তী সময়ে কাগজপত্র সঠিক পাওয়া গেলে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর থেকে লাইসেন্স দেওয়া হবে।
তবে বিষয়টি এত সহজ নয় বলেও জানান কয়েকজন খাদ্য ব্যবসায়ী। তারা বলেন, এ লাইসেন্স নিতে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। ঘুরতে হয়, রয়েছে ভোগান্তিও।
আবু সালাম নামে একজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, তিনি এ লাইসেন্স নিতে জেলা খাদ্য অফিসে ঘুস দিয়েছেন। তথ্য যাচাই-বাছাই করতে এসেও তার কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়েছে। আবার বছর বছর নবায়ন করতে বাড়তি কিছু টাকা দিতে হয়।
লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা যাবে না
ফুড গ্রেইন লাইসেন্স ছাড়া কেউ ধান-চালের ব্যবসা করতে পারবে না- এমন নির্দেশনা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। গত বৃহস্পতিবার তিনি সব বিভাগের খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের বলেন, ফুড গ্রেইন লাইসেন্স ছাড়া কেউ যেন ধান-চালের ব্যবসা না করে। লাইসেন্স ছাড়া কেউ অবৈধ মজুত করলে আইন অনুযায়ী প্রশাসনের কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নেবেন।
এর মধ্যে সারাদেশে গত কয়েকদিন লাইসেন্স নেই এমন কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা ও তাদের গুদাম সিলগালা করা হয়েছে বলেও জানা যায়। একইসঙ্গে তিনি বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের বলেন, ‘লাইসেন্সের আবেদন এলে সাতদিনের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স দেবেন। লাইসেন্সের জন্য ব্যবসায়ীদের যেন আপনাদের পেছনে ঘুরতে না হয়। আপনারা লাইসেন্স তাদের হাতে তুলে দেবেন।’
ঢাকা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জি এম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘এখন জোরালোভাবে প্রতিটি এরিয়া ধরে এ লাইসেন্সিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আমার বিভাগে প্রতিটি জেলা-উপজেলার এলাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছে। নির্দেশনা দিয়েছি, প্রতিটি ব্যবসায়ী যেন এ লাইসেন্সের আওতায় আসেন।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এ লাইসেন্স নেওয়া ও তথ্য দেওয়ায় অভ্যস্ত নয়। পাঁচ বছর ধরে অনেক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক সময় কেউ এ লাইসেন্স নিতো না। এখন নিচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে সবাই এ লাইসেন্সের আওতায় আসবে।’
লাইসেন্সের খরচ
পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারের জন্য নতুন লাইসেন্সের ফি পাঁচ হাজার টাকা। নবায়ন ফি আড়াই হাজার টাকা। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্য লাইসেন্স ফি এক হাজার এবং নবায়ন ফি ৫শ টাকা। একইভাবে বড় অটোরাইস মিলের জন্য পাঁচ হাজার টাকা, মাঝারি মিলের জন্য চার হাজার, ছোট মিল দুই হাজার এবং এসব লাইসেন্সের নবায়ন ফি অর্ধেক হারে নির্ধারিত।
এছাড়া, খাদ্যপণ্যের আমদানিকারক হলে ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের ফি ১০ হাজার এবং বাৎসরিক নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারিত। জাগো নিউজ।