মধ্যরাত। দুরন্ত গতিতে বাস ছুটছে। এলোমেলো। যেমন খুশি। গুটিকয় যাত্রী উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে। দু-একজন কণ্ঠ উঁচুতে তুলে মাঝেমধ্যে সাবধান হতে বলছে চালককে। চালকের সেদিকে কান নেই, তিনি কথা বলছেন হেলপারের সঙ্গে। কান খাড়া করতেই শোনা গেল, ‘আইজ একটাও ক্যালাশ (ক্ল্যাশ) হইল না’, হতাশ কণ্ঠে বলছেন চালক। হেলপার ‘হুম’ বলে সম্মতি দিচ্ছেন। এই আলাপ শোনাটা গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। হচ্ছেও। আর হচ্ছে বলেই, কেউ আর কোনো রা করল না। দৃশ্যটি কোনো কল্পনা থেকে আসেনি। বাস্তব কথোপকথন। এ কথোপকথন যখন চলছিল, তখন একজন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যও ছিলেন বাসটিতে। ডিউটিতে যাচ্ছিলেন, নাকি ডিউটি সেরে ফিরছিলেন, ঠিক বোঝা যায়নি। তবে অন্যদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনিও নির্লিপ্তই থেকেছেন।
ঠিক এ অবস্থাই এখন বাংলাদেশের। অঘটন নামের শব্দটা যেন প্রাণ পেয়েছে। আপন শক্তিতে সে অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছে, করে যাচ্ছে পরবর্তী অঘটনের পরিকল্পনা। কেউ কিছু বলছে না, করছে না। একের পর এক ঘটনার আবর্তে মানুষ দিশেহারা হচ্ছে, কিন্তু বলছে না যে, ‘আর না’। নিয়মরক্ষার মতো করে বাণী কিংবা প্রতিবাদ, মানববন্ধন অনেক কিছুই হচ্ছে, না হওয়ার ধাঁচে। একে ঠিক কী বলা যায়? নৈরাজ্য? না তা–ও বলা যায় না। বরং আধা-নৈরাজ্য বলা যেতে পারে।
দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে সাধারণত ‘নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি’ শব্দ বন্ধের প্রয়োগ দেখা যায়। এই প্রয়োগ নৈরাজ্য বলতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার ইঙ্গিত করে। কিন্তু নৈরাজ্য কি আসলেই তাই? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই না। নৈরাজ্য মানুষের স্বাধীন সত্তার কথা বলে। মানুষের ওপর রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাহ্য করে একটি স্বশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাই বলে নৈরাজ্যবাদ। সমাজের যাবতীয় কর্তৃত্ববাদী কাঠামোকে সে খারিজ করে মুক্ত শ্রম ও পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ একটি কাঠামোর প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের স্থির প্রচারিত সত্তার জন্য ভীষণভাবে অস্বস্তিকর। কারণ রাষ্ট্র এই প্রবণতাকে স্বাভাবিকভাবেই নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করে।
গত কিছুদিনে ঘটা কয়েকটি আলোচিত ঘটনাকে আমলে নিলে সহজেই বোঝা যাবে দেশে সে অর্থে নৈরাজ্য বিরাজ করছে না। রিফাত হত্যা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ইউএসটিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া কিংবা ছোট ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে ৮০ জন শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার ঘটনা—কোনোটিকেই ঠিক এ হিসাবে ফেলা যায় না। কারণ এগুলোর কোনোটিই রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে ঘটছে না। বরং রাষ্ট্রের ক্ষমতার সঙ্গেই এই ঘটনাগুলোর নির্মাতাদের ক্ষমতার উৎসের সম্পর্ক রয়েছে।
এ লেখায় অঘটনের তালিকা করা সম্ভব নয়। চলতি বছরের প্রথমার্ধে একনাগাড়ে যেসব হত্যা, ধর্ষণ, হামলাসহ নানামাত্রিক অপরাধের বিবরণ খবর হয়ে এসেছে, তার একটি বড় অংশের সঙ্গেই জড়িত তরুণেরা। শুধু তরুণ বললেও ভুল হবে, শিশু–কিশোরেরাও রয়েছে এ দলে। তাদের কার্যক্রম দেশের আইনি কাঠামোটি নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সমাজের এই অংশটির ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ যেন কাজ করছে না। তারা প্রকাশ্য রাজপথে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে, দুই পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, প্রবীণ শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেই থামছে না, তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিচ্ছে, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও পার পাচ্ছেন না।
এই যখন অবস্থা, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তরুণদের তবে কী হলো? তরুণেরা কি কোনো ‘রাজ’ আর মানতে চাইছে না? যেকোনো দেশের জন্যই তরুণেরা বড় সম্পদ। শারীরিক সক্ষমতা, উদ্দীপনা, নতুন ভাবনা—সব বিচারেই রথের চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার দায়টা থাকে তাদের ঘাড়েই। তাই তাদের প্রবণতাকে গুরুত্বের সঙ্গে ধর্তব্যে নিতেই হয়। আর সেভাবে তাদের দিকে তাকাতে গেলে একটু শঙ্কিতই হতে হয়। নিয়মিতই এমন সব অঘটনের খবর পাওয়া যাচ্ছে, যার সঙ্গে তরুণেরা জড়িত। কোনো আইন কিংবা সামাজিক রীতিনীতির ধার তারা ধারছে না। সমাজের সব শ্রেণি ও সব অঞ্চলের তরুণদের মধ্যেই এমন প্রবণতা রয়েছে। অবশ্য এ কথায় এমন ভাবার কারণ নেই যে সব তরুণের ক্ষেত্রেই এ কথা বলা হচ্ছে। দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন অর্জন তরুণদের হাত ধরেই আসছে, যাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। কিন্তু একটি অংশ যে নানা অঘটনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা তো সত্যই।
বিভিন্ন অঘটনে তরুণদের সম্পৃক্তিতে মনে হতে পারে যে রাষ্ট্রের কাঠামোটিকেই তারা আর মানছে না। কিন্তু বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। তাদের কর্মকাণ্ড যতটা না আইন না মানা, তার চেয়ে বেশি আইনকে অগ্রাহ্য করা। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণহীন মনে করছে। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণহীন মনে করাটা ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা-কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ স্পৃহাকে কোনোভাবেই প্রশ্নের আওতায় আনছে না। ফলে একে ঠিক নৈরাজ্যবাদের জায়গা থেকে নৈরাজ্য বলা যাবে না। কারণ নৈরাজ্যবাদ একটি মুক্ত কাঠামোর প্রস্তাব করে। বিপরীতে এই তরুণেরা কোনো মুক্ত কাঠামো নয়, বরং বিদ্যমান ভয়ের সংস্কৃতিকেই পুনঃ প্রস্তাব করছে, অনেকটা শুরুতে বর্ণিত ওই বাসচালকের মতো। এ ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোকেই নিজেদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে তাই নৈরাজ্য নয়, বরং ‘আদর্শহীন নৈরাজ্য’ হিসেবেই আখ্যা দেওয়া যায়।
কথা হচ্ছে তরুণদের মধ্যে এই ‘আদর্শহীন নৈরাজ্যিক’ প্রবণতা সৃষ্টি ও এর বিস্তৃতির কারণ কী? এর কারণ খুঁজতে গেলে রাষ্ট্রের কাঠামোর দিকেই তাকাতে হবে। মোটাদাগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনমনের কথা বলা যেতেই পারে। কিন্তু এটি ঠিক কতটা, তা বোঝা যাবে কোনো একটি অপরাধ বেড়ে গেলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিয়ে যাওয়ার যে জনস্পৃহা তৈরি হয়েছে, তার কার্যকারণ সূত্রের মধ্যে।
বেশ কিছুদিন ধরেই ধর্ষণের মতো ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। শুরুতে ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠলেও রাষ্ট্রের পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনার হার বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে অপরাধীকে বন্দুকযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার দাবি উঠতে থাকে। এই একই প্রতিক্রিয়া এখন যেকোনো সিরিজ অপরাধের ক্ষেত্রে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রতিটি অনলাইন ও অফলাইন ফোরামে এ ধরনের বক্তব্য শোনা যায়, যা রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি জন-অনাস্থারই প্রমাণ। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের এই অনাস্থা কমাতে সক্রিয় হওয়ার কথা থাকলেও তা করেনি। বরং এই বেআইনি পথটিতেই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজতে দেখা গেছে তাকে। যেন রাষ্ট্র নিজেই আর নিজের আইনি কাঠামোর ওপর ঠিক ভরসা পাচ্ছে না। এটা নিজের আইনি কাঠামোর দুর্বলতার বিষয়ে রাষ্ট্রের স্বীকারোক্তি বলা যায়। সাধারণ আইনি পথে না হেঁটে, রাষ্ট্র যে পথে হাঁটছে, তা প্রকারান্তরে তরুণদের অনিয়ন্ত্রিত করে তুলছে।
বিষয়টি বুঝতে হলে তাকাতে হবে আরেকটি দিকে। সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতির দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কারণ বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তরুণ। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। একে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতির চাকা গড়গড় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু তা না হলে অলস বসে থাকা তরুণেরা কী করবে, যখন তাদের সামনে রয়েছে দুর্বল আইনি কাঠামোর রাষ্ট্রীয় স্বীকারোক্তি, যখন তাদের সামনে নেই কোনো আদর্শ? এ পরিস্থিতিই একটি ‘আদর্শহীন নৈরাজ্য’ দশার জন্য মোক্ষম পরিবেশের সৃষ্টি করে।
বিদ্যমান একমুখী অবস্থার কারণে তরুণদের মধ্যে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ সে তার প্রাণশক্তি ও মগজ দুইয়ের ব্যবহারই পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারছে না। রাষ্ট্র তাকে কাজে লাগাচ্ছে না, আবার কোনো আদর্শও তার সামনে নেই। ফলে সে তার শক্তিক্ষয় করছে যেনতেনভাবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য এক বিরাট অপচয়। এই অপচয় রুখতে হলে এই তরুণদের নিয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে। সমাজের প্রতিটি অংশকে এ পরিকল্পনায় অঙ্গীভূত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রকেই তার সৃষ্ট আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তা না হলে এই আধা-নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিই, ‘উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির’ তাবৎ স্লোগানকে ফাঁপা প্রমাণ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক