বর্তমান ডিজিটাল যুগে এমন কাউকে পাওয়া খুবই কঠিন যার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট নেই। যেকোনও অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল তার বক্তিসত্তা কিংবা ব্যক্তিত্বের চিত্র অংকন করে। তাই নিছক সময় পার করা নয়; বরং এখন এই চিন্তাও আমাদের করতে বাধ্য করছে– কখন কোন পরিস্থিতি বা বাস্তবতায় নিজ প্রোফাইলের মাধ্যমে আমাদের কী ধরনের পোস্ট, মন্তব্য বা শেয়ার করা উচিত। এ ধরনের কাজগুলো আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাদার অবস্থানকেও অনেক সময় চিহ্নিত করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশে ফেসবুকই বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু আমার এ লেখায় ইন্সটাগ্রাম নিয়ে আলোচনা করবো।
যারা ইন্সটাগ্রাম সম্পর্কে খুব একটা জানেন না (যদিও আমি মনে করি এই আধুনিক যুগে সবাই ইন্সটাগ্রাম চেনেন) তাদের জানিয়ে রাখি– ইন্সটাগ্রামে শুধুমাত্র আমরা ছবি বা ভিডিও শেয়ার করতে পারি। অর্থাৎ ছবি, ভিডিও এবং ট্রেন্ডিং কোনও কন্টেন্ট শুধু আপলোডই নয় বরং বিভিন্ন ফিল্টার ব্যবহার করে একে দৃষ্টিনন্দনভাবে সম্পাদনাও করা যায়।
ইন্সটাগ্রামে শেয়ার করা ছবি বা ভিডিগুলোর দর্শক বা শ্রোতা কারা হবে? এটাও ঠিক করে দেওয়া সম্ভব। অনুমতি দিলে ভিউয়ার বা ফলোয়াররা সরাসরি যেকোনও ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করতে পারবেন। সময়ের পরিক্রমায় এটি ‘মেসেজিং’ ও ‘স্টোরি’ নামক অপশনও যুক্ত করেছে। স্টোরিতে কোনও ছবি, ভিডিও দিলে তা শুধু ২৪ ঘণ্টার জন্যে দৃশ্যমান থাকে।
ইনফ্লুয়েন্সার বিপণন
আমরা একটা বিষেশণ ব্যবহার করি- সেটা হলো, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি’। আসলে এই বিশেষণটির বদলে ইনফ্লুয়েন্সার বলা ভালো। ইনফ্লুয়েন্সার মানে হলো যারা ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। একইসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের মতামত বা অভিজ্ঞতাকে তার ভক্তরা বিশ্বাস করেন। এটা প্রভাবক হিসেবেও কাজ করে।
যা হোক, অনেক পাঠক জেনে কিছুটা অবাক হবেন যে বেশ সংখ্যক ‘হেভি ওয়েট’ ব্যবহারকারী বর্তমানে ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পণ্য বা সেবা বিক্রির প্রচারণা করেন। যাদের বলা হয় ‘ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার’। আর যেখানে ভোক্তার কাছে পণ্য বা সেবা বিক্রির বিষয়টি আসে সেখানে স্বভাবতই ভোক্তার অধিকার এবং বিক্রেতা বা প্রচারকের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও চলে আসে। এই বিষয়টি আলোচনার আগে খুব ছোট করে জানা প্রয়োজন যে এই ‘হেভি ওয়েট’ ব্যবহারকারী অর্থাৎ ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার বলতে নির্দিষ্ট করে কাদের বোঝানো হচ্ছে। একইসঙ্গে তারা নিজেরা ওই সেবা বা পণ্যগুলো কীভাবে ব্যবহার করে থাকেন।
বর্তমানে অনেক ইনফ্লুয়েন্সার ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রির জন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। ইনফ্লুয়েন্সাররা খুব কৌশলে তাদের ফলোয়ার বাড়িয়ে থাকেন এবং একটি সেবা বা পণ্যের প্রচারের জন্যে নিজের ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। পরে এর পক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রমাণও রাখেন। লক্ষ্য একটাই, পণ্য ও সেবার প্রচারণা ও বিক্রি বৃদ্ধি।
এভাবে এক বিলিয়নেরও বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী নিয়ে সর্বাধিক ডাউনলোডযোগ্য অ্যাপ হিসাবে ইন্সটাগ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের অনেক ব্র্যান্ডগুলোর পক্ষে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মাধ্যম, যা অধিকাংশ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
একজন ইনফ্লুয়েন্সারের পারিশ্রমিক বা সম্মানীর পরিমাণ!
আমার স্ত্রী একজন ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার। এ কারণে আমার জানার সৌভাগ্য হয়েছে, এসব পণ্য বা সেবার ব্যবসায়িক প্রচারণার জন্য একজন ইনফ্লুয়েন্সার ঠিক কত টাকা আয় করেন। খাবার, মেকআপ, পোশাক ও ফ্যাশন নিয়েই প্রচারণা চালানোটা বেশিরভাগ দেখা যায় এখন। এসব ইনফ্লুয়েন্সারদের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে গেছে যে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আন্তরিকভাবে প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও বিনিময়ে কোনও নগদ অর্থ ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে অধিকাংশ সময়েই পাওয়া যায় না।
তারা অর্থের বদলে দিচ্ছেন পণ্য। যেমন, খাবারের ব্র্যান্ড হলে বিনামূল্যে কিছু স্ন্যাকস, মেকআপ-এর ব্র্যান্ড হলে অল্প কিছু মেকাপ সামগ্রী, পোশাকের দোকান হলে এক সেট পোশাক বা সর্বোচ্চ সেই হাউজের মডেল হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে।
যাহোক, যদিও আমার স্ত্রীর কাছে আসা ফ্রি খাবারটি পুরোপুরি উপভোগ করেছি। এমনকি অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে নাপিত এনে ফ্রি চুল-দাড়ি কাটিয়ে নিয়েছি।
কিন্তু একজন আইনজীবী হিসেবে এই চিন্তাটাও আমার মাথায় উঁকি দিয়েছে যে এই ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রচারণা থেকে প্রভাবিত হয়ে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে যদি কোনও ক্রেতা ক্ষতির শিকার হয়ে আদালতে যান তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?
প্রচলিত আইনের যেসকল ধারা ‘ঠকবাজ’ ইনফ্লুয়েন্সারদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যে আইনটি আসলে বাংলাদেশের ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সারদের বিপদে ফেলতে পারে তা হলো ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন।
বাংলাদেশের এই আইনটির ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।”
এতে একবিন্দু সন্দেহও নেই যে কোনও ইনফ্লুয়েন্সার যদি খারাপ কোনও উদ্দেশ্য মাথায় না নিয়েও সরল মনে শুধু উত্তেজনার বশে বা কথাচ্ছলে এমন কোনও তথ্য দিয়ে থাকেন যা সত্য নয় এবং যা থেকে গ্রাহক প্রতারিত হয়, সেক্ষেত্রেও সেই ইনফ্লুয়েন্সার এই আইনের অধীনে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন।
সহজ করে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, একজন ইনফ্লুয়েন্সার একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের ব্রন ভালো করে দেওয়ার ক্রিমের পক্ষে একটি ভিডিও পোস্ট করলেন। যেখানে হয়তো তিনি বলছেন, ‘এই পণ্যটি শতভাগ গ্যারান্টিসহ একদিনের মধ্যে আপনার পিম্পল সাফ করে দেবে।’
এখন, যদিও এই কথাটি একজন উত্তেজনাবশত বা নামমাত্র সম্মানীর বিনিময়ে কোনও প্রকার খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়াই বলেছেন। এখন যদি কোনও ব্যবহারকারী এর সুফল না পান তবে যে কেউ প্রতারিত বোধ করতে পারেন। পরবর্তীতে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারেন।
যে ধরনের কোনও প্রচারণা যা দ্বারা ভোক্তা প্রতারিত হতে পারেন তাকে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিরোধী অনুশীলন’ বলা হয়। আইনটির ধারা ২(২০)(ঘ) -এর অধীনে কেবল চিহ্নিতই করা হয়নি বরং আইনটির ধারা ২১(২)(ঝ)-এর অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে পর্যবেক্ষণ করার অধিকারও দিয়েছে। বলা আছে, কোনও ভোক্তা বা ক্রেতা কোনও অমূলক প্রচারণার ফলে প্রতারিত হলে সেক্ষেত্রে সেই প্রতারিত ব্যক্তি ন্যায়-বিচার পাচ্ছেন কিনা এবং ওই প্রতারকের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা সেটাও তাদের খেয়াল রাখতে হবে।
আর আইনটিতে (আইনটির ধারা ৭৬ অনুসারে) জরিমানার ২৫ % ভোক্তার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ফলে এখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে কেউ এ ধরনের মামলা করে দিতে পারেন।
এখন যারা পণ্য প্রচারণার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার যেকোনও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন তাদের সচেতন হতে হবে।
প্রথমেই বলবো, একটি পণ্য বা সেবার প্রচারণা চালানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই কোনও ছবি বা ভিডিও বা বক্তব্য যেন এই আইন ভঙ্গ না করে।
ইন্সটাগ্রামে কোনও পণ্যের প্রচারণার আগে দেখে নিতে হবে তার অনুমোদন আছে কিনা। নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, আমি এতটা সময় ব্যবহার করেছি এবং ফলাফল পেয়েছি। এখানে কৌশলী হতে হবে।
কিছু কিছু প্রচারণা পোস্ট করার পরে নিচে সম্পূরক বার্তা রাখা ভালো। যেমন, এই পণ্যটির প্রচারণা আমি টাকার বিনিময়ে করছি, আমার সাথে এর ব্যক্তিগত কোনও অভিজ্ঞতা বা সম্পর্ক নেই। অথবা এই পণ্যটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই এই সতর্কতা অবলম্বন করুন।
মোট কথা কোনও পণ্যের কার্যকারিতা যদি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অপেক্ষা রাখে (সাধারণত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পণ্য) তবে পণ্যপ্রস্তুত বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সে ধরনের প্রমাণ সংরক্ষণ ব্যতিরেকে প্রচারণা না চালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সুত্র:[বাংলা ট্রিবিউন]