ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সরবরাহ ঠিকই আছে। গোডাউন কিংবা মিলে অতিরিক্ত চালের মজুত নেই বলে জানিয়েছে জেলা খাদ্য অধিদপ্তর। তারপরও খুলনার চালের বাজারের অস্থিরতা কোন ভাবেই কাটছে না।
সব ঠিক থাকার পরও দাম কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ছোট ব্যবসায়ীরা দেখিয়ে দিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীদের আর বড় ব্যবসায়ীরা পাইকার ও মিলারদের দায়ী করছেন। অন্যদিকে পাইকার ও মিলাররা দায়ী করছেন বড় বড় কোম্পানিগুলোকে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেশ কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত চাল বিক্রি শুরুর পর থেকেই বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকছে সব সময়।
এদিকে, চালের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রায় দিন ক্রেতাশূন্য থাকছে খুলনার বড় বাজার।
রিকশাচালক আব্দুর রউফ বলেন, ‘গরীবের চাল বলে পরিচিত স্বর্ণা। সেটিও প্রতি কেজিতে তিন টাকা করে বেড়েছে। বাড়েনি আয়। পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। কারণ প্রতিমাসে আমার ৪০ কেজি চালের প্রয়োজন হয়। এ চাল কিনতে এখন আরও বেশকিছু টাকা বাড়তি আয় করতে হবে।’
খুচরা চাল বিক্রেতা শাহাদাত মৃধা বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে চালের বাজারে উত্তাপ ছাড়াচ্ছে। এবার দেশে বোরোর আবাদ বেশ ভালোই হয়েছে। ধানের কোনো সংকট নেই। চালের দাম বাড়ল কেন? বাজারের বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছে। তাদের গোডাউনে অভিযান করলে প্রকৃত রহস্য বের হয়ে আসবে। চালের দাম বেশি হওয়ায় বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম।
খুলনা মহানগরীর সবচেয়ে বড় চালের মোকাম হিসেবে পরিচিত খুলনার বড় বাজারের চাল পট্টি ঘুরে জানা গেছে, প্রতি কেজি নতুন সরু মিনিকেট চাল ৬৮ টাকায় বিক্রি করছেন খচরা ব্যবসায়ীরা। অনুরূপভাবে মাঝারি নতুন মিনিকেট ৬৫ টাকা, বাঁশমতি ৮০ টাকা, নাজিরশাইল ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ একসপ্তাহ আগেও একই চাল ব্যবসায়ীরা ৫-৯ টাকা কমে বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও দাম বাড়ার খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকাররা একে অপরের ওপরকে দুষছেন।
তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় মিল মালিকরা অতিমাত্রায় ধানের মজুত করায় দফায় দফায় চালের দাম বেড়ে চলেছে।
বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা বাসুদেব কুন্ডু দাম বাড়ার জন্য সরাসরি মিল মালিকদের দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘মিলাররা বিভিন্ন হাটে হাটে গিয়ে নতুন ধান কিনে মজুত রাখছে। চালের দাম বৃদ্ধির সংবাদ জেনে সেগুলো তারা বাজারজাত করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত একসপ্তাহ আগেও বাজারে চালের সরবরাহ খুবই কম ছিল। মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযানের খবরের পর চালের সরবরাহ একটু বেড়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, অতিরিক্ত মজুতনীতির কারণে বেড়ে চলেছে চালের দাম। হাটের দর থেকে অতিরিক্ত দামে ধান কিনে মিলে নিয়ে যাচ্ছে। ধানের সংকট দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে।
তিনি আরও বলেন, এলসির চাল বাজারে নেই। এ সুযোগে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এই করপোরেট সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
বাজারের দিনাজপুর ভান্ডারের মালিক মো. ফারুখ আহমেদ বলেন, সরকার মিল মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোন দিচ্ছে। এ টাকা দিয়ে তারা হাজার হাজার মণ ধান কিনে মজুত করছে। চালের সংকট পড়লে তখন তারা চাল বাজারজাত করবে। সিলেটের বন্যার কথা বলে তারা চালের দাম এক দফা বৃদ্ধি করছে। সিলেটের চাল খুলনায় আসে না। সেখানে বন্যা হলে এখানকার বাজারে উত্তাপ বাড়বে কেন? চালের দাম কমানোর জন্য দেশের নামীদামী মিলগুলোতে নিয়মিত অভিযানের অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে খুলনা ধান-চাল বণিক সমিতির সভাপতি মনির আহমেদ বলেন, গত তিন যুগ ধরে চালের দাম এমন ঊর্ধ্বমুখী দর কখনো দেখিনি। কেন দাম বাড়লো তাও বলতে পারছি না। একসময় হাসকিং মেশিন দিয়ে ধান ছাঁটাই করে চাল বের করা হতো। আমরা মিলে গিয়ে গিয়ে চাল কিনে আনতাম। এখন ধান-চালের রাজত্ব করে অটোরাইস মিলগুলো।
তিনি আরও বলেন, পাইকারি বা খুচরা ব্যবসায়ীরা খুব বেশি পরিমাণ ধান-চালের মজুত করতে পারেন না। তাদের তেমন জায়গাও নেই। মজুত করতে পারেন অটোরাইস মিলগুলোর মালিকরা। তারাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন।
খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ বাবুল হোসেন বলেন, চাল বা ধান মজুতের কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে বলেছেন। সেই অনুযায়ী কাজও হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জেলায় দুই শতাধিক লাইসেন্সধারী হাসকিং রাইচমিল রয়েছে। এছাড়া ১৪টি অটোরাইস মিলও আছে। সরকারি আইন অনুসারে, আমরা নিয়মিত ওই মিলগুলো পরিদর্শন করছি। আমাদের কয়েকটি দল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মিল পরিদর্শন করেছে। একই সঙ্গে লাইসেন্সধারী পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের গোডাউনও আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করছি। মজুত আইনে যা আছে, তার বেশি ধান বা চাল খুলনার কোনো মিলে এখনো পাওয়া যায়নি।