এস এম রাজিব: ভোক্তাদের দাবি এবং বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা উপেক্ষা করেই আবাসিক ও শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম ঘন মিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এতে এখন থেকে এক চুলার গ্যাসের জন্য প্রতি মাসে দিতে হবে ৯৯০ টাকা। আর দুই চুলার জন্য দিতে হবে ১ হাজার ৮০ টাকা।
এছাড়াও, প্রিপেইড মিটারে প্রতি ঘন মিটার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ টাকা, এটি আগে ছিল ১২ টাকা ৬০ পয়সা। আর সার কারখানায় সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য প্রতি ঘন মিটারে ১৬ টাকা দিতে হবে বলে জানিয়েছে বিইআরসি।
এদিকে, গ্যাসের দাম একবারে এতোটা বাড়ানোর ফলে বিপাকে পড়েছেন বাসা-বাড়ি ও শিল্প কারখানার মালিকরা।
এছাড়াও, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক এবং জনবান্ধব পরিপন্থী হিসাবে আখ্যা দিয়েছে অনেকেই।
মালিবাগ চৌধুরী পাড়া এলাকার বাড়ির মালিক জয় সোহাগ বলেন, ‘দিন দিন দৈনন্দিন খরচের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাচ্ছে। এরপর যদি আবার গ্যাসের দাম বাড়ে, তাহলে তো জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে। বাড়ির মালিকদের খরচ বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবে। আর এতে তো ভাড়াটিয়াদের উপরেও প্রভাব পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাস আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ। আর এই সম্পদ ব্যবহারেই যদি এতো দাম দিতে হয়। তাহলে তো আমদানি করা পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। তাই আমি মনে করি সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার ভাড়াটিয়া রুনা বেগম বলেন, ‘দিন দিন জিনিসপত্রের যে দাম বাড়ছে, এতে তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই মুশকিল। বাজার করতে গেলে তো দাম শুনেই চোখ কপালে উঠে যায়। ধরেন, গতকাল যে জিনিসটা ২০ টাকায় কিনেছি, আগামীকাল কিনতে গেলেই বলবে ২৫ টাকা। তারপর আছে আবার বাসা ভাড়া। কোন কিছুর দাম বাড়লেই বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়। এর মধ্যেই আবার গ্যাসের দাম বেড়েছে, হয়তো খুব শিগগিরিই ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করবে বাড়ির মালিকরা। তাহলে আমরা কিভাবে চলবো।’
টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল-মুসলিম গ্রুপের ম্যানেজার শাহ-আলম বলেন, ‘একটা জিনিসের দাম বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই সকল বিষয়ের উপর তার প্রভাব পরে। যেহেতু কোম্পানির একটা শর্ত থাকে। আর তা হলো, লাভ বেশি হলে সেখান থেকে আমাদের একটা পারসেন্টেন্স বোনাস হিসাবে দেয়। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়লে তো লাভ কমে যাবে বা ঘাটতি থাকবে, তখন তো কমিশন থেকে বঞ্চিত হবো। কারণ খরচ বাড়লেই তো আর বায়াররা (বিদেশী ক্রেতা) বেশি দামে পণ্য কিনবে না।
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে দাবি, সরকার যেন গ্যাসের দাম একবারে এতো না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে কম কম করে বাড়ায়। তাহলে ভালো হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে শাহ-আলম বলেন, ‘খরচ বাড়লেই তো আর দাম বাড়ানো যায় না। আপাতত এখানে লস (ক্ষতি) দিতে হবে। হয়তোবা শ্রমিকদের উপর এর প্রভাব পড়বে (মালিক পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে)। তাদের কাজের টার্গেট বাড়াতে হবে। বায়ারদের বললেই তো আর তারা দাম বাড়িয়ে দেবে না। বরং তারা ভারত নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য কিনবে।’
এ বিষয়ে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং বিইআরসি যেভাবে মূল্য বৃদ্ধি করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে তারা আমাদের প্রস্তাব আমলে নেয়নি। আমরা এখন তাদের আদেশের যে জায়গাগুলোতে দুর্বলতা আছে, যে জায়গাতে সুযোগ আছে সেই সকল জায়গাতে সমন্বয় করে মূল্য বৃদ্ধির আদেশগুলো বিবেচনা করার জন্য আহ্বান করবো। কারণ আমরা চেয়েছিলাম অন্যায় ও অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি না করে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে লুণ্ঠনমূলক ব্যবসা প্রতিরোধ করে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করে আদেশ দিতে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলে, যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার যে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে, বাদ বাকি যে ছয় হাজার ৩২৫ কোটি টাকা, সেটার মূল্য বৃদ্ধি না করে সমন্বয় করা যেত ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) নানা ধরনের এডজাস্টমেন্টের (সমন্বয়) মধ্যে দিয়ে।’
রিভিউ পিটিশনের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সেটাই আবার উল্লেখ করে রিভিউ পিটিশন দিতে যাচ্ছি। হয়তো আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে পিটিশন দাখিল করতে পারবো।’
বাংলাদেশে সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন গ্যাসের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি ঘন মিটার নয় টাকা ৭০ পয়সা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তার মধ্যে দুই হাজার ৩০০ ঘনফুট গ্যাস দেশিয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৭৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট এলএনজি গ্যাস আমদানি করা হয়।