একদিকে আমদানির চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে পড়েছে টান। ফলে বাড়তি চাহিদার কারণে হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ ঠিক রাখতে বেশি পরিমাণে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২০৩ কোটি ২০ লাখ বা ২ হাজার ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ হস্তক্ষেপকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। এতে আমদানি বেড়েছে। অন্যদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স কম আসছে। এ কারণে বাজারে বাড়তি ডলারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, দাম বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির পদক্ষেপ সময়োপযোগী হয়েছে। যদি তারা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ডলার বিক্রি না করত, তাহলে দাম আরও বেড়ে যেত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশ আমদানি-নির্ভর। ডলারের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামালের দাম বাড়ে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ে। সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির পদক্ষেপ নিয়েছে। যা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
এদিকে, দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর চলতি বছরের আগস্টের শুরু থেকে হঠাৎ বাড়তে থাকে ডলারের দাম। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনর জন্য প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। যা নভেম্বরের শুরুতে ছিল ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা। অক্টোবরের শুরুতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে এক ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ৮৫ টাকা ২০ পয়সা। আগস্টে ডলার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। চার মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার দর হারিয়েছে এক টাকা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা স্থিতিশীল ছিল মার্কিন ডলার।
গত ১৯ আগস্ট প্রথম ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়েছে, যা বর্তমানে দেশের মুদ্রাবাজারে টাকার টান তৈরির অন্যতম কারণ।
এর আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সবমিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কেনে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনে আর্থিক খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আমদানি দায় মেটাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দেশি ও বিদেশি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত নিচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন নগদ ডলার বিক্রি করছে ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়। অবশ্য ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় বাড়তি ঝামেলা, সার্ভিস চার্জ এবং নির্ধারিত সীমার বেশি কেনার সুযোগ না থাকায় অনেকে ব্যাংকে না গিয়ে খোলাবাজার থেকে কিনে থাকেন।
এদিকে আন্তঃব্যাংকের পাশাপাশি নগদ ডলারের দরও বেড়েছে। খোলাবাজারে এখন নগদ ডলার ৯০ থেকে ৯২ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত মহামারির কারণে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর সম্প্রতি খুলে দেওয়ায় এখন বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ডলার প্রায় দুই বছর স্থিতিশীল ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে মূলধনীয় যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। এসব পণ্যের দায় ও আগের বকেয়া পরিশোধ করতে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। এখন ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে ডলার আহরণসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে আগামীতে ডলার সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৮৭২ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। আমদানি বাড়লেও সেই হারে রফতানি বাড়েনি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রফতানি হয়েছে এক হাজার ৮১ কোটি ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ে চেয়ে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। এতে করে চাপের মুখে পড়েছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫০ কোটি ডলারে।
মহামারি করোনার শুরুর দিকে প্রবাসী আয়ে চাঙাভাব থাকলেও চলতি বছরের জুন থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সবশেষ নভেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ (১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বা ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা কম। গত বছরের নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। শুধু তাই নয়, নভেম্বরের রেমিট্যান্সের এ পরিমাণ গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসের দেশে ১৫০ কোটি ডলার সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছিল।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো চাইলেও বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। বৈদেশিক মুদ্রা রাখার বিষয়ে প্রতিটি ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা আছে; যাকে এনওপি বা নেট ওপেন পজিশন বলে। যদি কোনো ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার মজুত থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়। নয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হয়। কেউ নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজের কাছে ধরে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়। জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই তাকে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়।