এস এম রাজীব: আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এ বাজেটের মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ লুণ্ঠন হওয়ার শঙ্কা করছেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. এম সামসুল আলম।
২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট বিষয়ে ভোক্তাকণ্ঠকে দেওয়া এক মন্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য বাজেটের বরাদ্দটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই খাত উন্নয়নের জন্য যে ব্যয় ধরা হচ্ছে, সেই খাতের অযৌক্তিক এবং লুণ্ঠনমূলক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা। এই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেহেতু বাজেটে উপেক্ষিত থাকছে বরাবরের মতোই, তার মানে এই অযৌক্তিক এবং লুন্ঠনমূলক ব্যয়কে বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধির অর্থলিপ্সা হিসেবে উৎসাহিত করছে বলে আমার মনে হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বাজেটের মাধ্যমে ভোক্তা সেবার কথার প্রশ্নই ওঠে না। এই বাজেটের মাধ্যমে অর্থ (কালোবাজারির মাধ্যমে) লুণ্ঠিত হবে। তাই এটি একটি লুণ্ঠনমূলক বাজেট।’
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব ছিল ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে (২০২২-২৩) গত অর্থবছরের চেয়ে তিন হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ চেয়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়টি।
প্রস্তাবিত এ বাজেটে বিশ্ব বাজারের জ্বালানি সংকটের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থছরের মূল বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা, যা পরে সংশোধনে ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। সেই হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় গতবারের বরাদ্দ বেড়েছিল ১৫.৫ শতাংশের মত।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতের জন্য মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৭১১. ৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এ খাতে ৬০টি প্রকল্পে এ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিল (জিওবি) থেকে নয় হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, সংস্থার নিজস্ব তহবিল তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকা এবং পিএ (প্রকল্প সাহায্য) ১৪ হাজার ৭৩১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
জানা গেছে, এই ৬০ প্রকল্পের নয়টি একেবারেই নতুন প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- পেট্রোবাংলার পাঁচটি, ব্লু ইকোনমি সেলের দুটি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) একটি ও ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতরের (জেএসবি) একটি প্রকল্প।
আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি খাতের বাজেটে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হবে তিন হাজার ২০১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এ খাতে ৩৯টি প্রকল্পে এ বরাদ্দ চাওয়া হবে। এর মধ্যে সরকারি তহবিল (জিওবি) থেকে এক হাজার ৮২১ কোটি ৫২ লাখ টাকা, নিজস্ব অর্থায়নে ২৪ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ২৯ কোটি নয় লাখ টাকা এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৩১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বাজেটে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হবে। এছাড়া জ্বালানি খাত থেকে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হবে ৩৫ কোটি টাকা।
গত বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ খ ম মোস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। দুই হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। পাশাপাশি ৬২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বাজেটে ভোক্তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি জানিয়ে ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে বাজেট প্রত্যাশা নিয়ে মতবিনিময় করে থাকে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও বাজেটে তাদের প্রত্যাশা নিয়ে পৃথক ভাবে সংলাপের আয়োজন করে। এবারও যথারীতি তারা সে আয়োজন করেছেন। আবার বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমও ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে বাজেট প্রত্যাশা নিয়ে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকার প্রচার করছে। বিষয়টি দেখে প্রশ্ন জাগতে পারে, জাতীয় বাজেট কি শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য; না কি সমাজের অন্যসব শ্রেণি-পেশার মানুষেরও বাজেট নিয়ে কোন ভাবনা আছে?’
এক প্রশ্নের জবাবে ভোক্তাকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে যতটা পাওয়ার কথা সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না ভোক্তারা। সরকার বিদ্যুৎ খাতে যদিও বরাদ্দ দিচ্ছে, তবে বলতে গেলে তার পুরোটাই বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা কালোবাজারির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যেটা দাবি তা হলো, বিদ্যুতের সেবা যেন ভোক্তা পর্যায়ে আরও প্রণোদনার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়। সরকার যা দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যাচ্ছে। এখানে সেবাটা ব্যবসায়ীদের দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেবাটা ভোক্তা পর্যায়ে যাচ্ছে না। এখানে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর বিষয়ে উল্লেখ করে দিতে হবে। তবেই ভোক্তারা পুর্ণাঙ্গ সেবা পাবে।’
রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ভবিষ্যতে জ্বালানি সংকট এড়াতে এখনই প্রস্তুতি নিতে চায় জ্বালানি বিভাগ। অন্যদিকে এ বছরই দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ শেষ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগ মনে করে- এখন বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের পাশাপাশি মূল্য সাশ্রয়ী রাখাই তাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।