ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে চরম সংকটে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। দ্রব্যমূল্যের ক্রম ঊর্ধ্বগতিকে কেউ কেউ দাবানলের সঙ্গে তুলনা করছেন। আগে যেখানে প্রচলিত বাক্য ছিল ‘বাজারে আগুণ লেগেছে’।
চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে অতি প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামের একই অবস্থা। নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য করোনা মহামারিতে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা, সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আবার কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ বাজারের সুশাসনের অভাবকেও দায়ী করছেন।
ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির মতে সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরতে না পারে কিংবা আয় বৈষম্য কমানো না যায়।
ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই এক ধরনের মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা রয়েছে। আমাদের আমদানি ও রফতানি বেড়েছে, বেড়েছে তারল্য প্রবাহ। যার প্রভাব বাজারেও এসেছে।
তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করে ক্যাব সভাপতি বলেন, প্রথমত করোনার কারণে অনেক পণ্যেরই উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। যার ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে চাল থেকে শুরু করে সকল পণ্য এখন আমদানি নির্ভর। কোনো কোনো পণ্য ৮০-৯০ শতাংশ, কোনো পণ্য ৫-১০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কম পরিমাণ আমদানি হলেও সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের সুযোগসন্ধানী আচরণ। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যখন দাম কমে, তখন পণ্যের দাম কমার প্রবণতা দেখা যায় না। এ বিষয়টি ব্যবসায়ীদের খাতায়ই নেই।
সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে— এমন মন্তব্য করে তৃতীয় কারণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যেমন- ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম ওই সময় বৃদ্ধি না করলেও চলত। কারণ, বিগত কয়েকবছর জ্বালানি বিভাগ প্রচুর লাভ করেছে। আমরা সব সময় বলে এসেছি ভর্তুকি দরকার নেই, যখন বেশি দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে একটি ‘প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ তৈরি করা হোক। যা দিয়ে যখন দাম বাড়বে তখন সেটা সমন্বয় করা যায়। কিন্তু তারা সেটা না করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় ও বাকি টাকা সরকারকে দেয়।
গোলাম রহমান বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার চেয়ে বর্তমান সরকারের প্রধান ফোকাসের জায়গায় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবৃদ্ধি। আয় বৈষম্য বেশ বেড়েছে। যার সাথে আইয়ুব সরকারের মিল পাচ্ছি। তখন ২২ পরিবারের প্রসঙ্গটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যদি পিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদেরকে পিষ্ট করবে। সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরা না যায়। অথবা আয় বৈষম্য কমানো না যায়। এক সময় আমরা বলতাম নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, এখন বলি বাজারে দাবানল চলছে।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার বর্তমান সংকটে বাজারে নতুন কোনো প্রভাব পড়বে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই বিশ্ববাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে।
অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাবকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করছেন।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ বিষয়ে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। অতিমারির সময় মানুষের আয় কমে গিয়েছে, কর্মসংস্থান নেই অনেকের। তার ওপরে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব থাকে, যে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাস্তবতার আলোকে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিরাট ফারাক রয়েছে।
অন্যদিকে লাগামহীন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সাময়িক সময়ের জন্য কর কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এছাড়া কাঁচামালের বহু কারখানা বিদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে রাসায়নিক কারখানা। এমন প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা আগেই শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সুপারিশ রাখা হয়নি। এসব কারণে এখন বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সামনে পবিত্র রমজান, এখনই দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।