ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক
করোনা সংক্রমণের কারণে অনেকেই চাকরি ও আয়ের পথ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। অসহায় এসব মানুষকে পূঁজি করে অনেকে আবার নেমেছেন ডিজিটাল সুদের ব্যবসায়।এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘র্যাপিড ক্যাশ’।
ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে ৭ দিন পর ফেরত দিতে হবে ২ হাজার ৫ টাকা। মাত্র ৫ টাকা সুদ দিতে হবে জেনে অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করেছেন ‘র্যাপিড ক্যাশ’ নামে একটি অনলাইন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপে। নিবন্ধনকারীদের অধিকাংশই আবেদন করছেন সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা ঋণের জন্য।
তবে মোবাইলে ঋণের টাকা জমা হওয়ার বার্তা আসার পরেই চিন্তা শুরু হয় গ্রাহকের। ২ হাজার টাকার পরিবর্তে টাকা আসে ১৬৮৫। ৭ দিনের মধ্যে ১৬৮৫ টাকার বিপরীতে জমা দিতে হবে ২০০৫ টাকা। না দিতে পারলে সুদ প্রতিদিন ১০০ টাকা। এক মাস পর থেকে সুদ প্রতিদিন ২০০ টাকা। এর এক সপ্তাহ পর থেকে সুদ ৪০০ টাকা।
সম্পূর্ণ মহাজনি প্রথার এ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে অসংখ্য গ্রাহককে পথে বসিয়েছে এ যুগের ডিজিটাল মহাজন ‘র্যাপিড ক্যাশ’।
কথিত এই ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ‘র্যাপিড ক্যাশ’ নিজেদের মাইক্রো ফিন্যান্সিয়াল অ্যাপ বলে দাবি করেছে ডিজিটাল মাধ্যমে। গুগল প্লে স্টোর থেকে তাদের অ্যাপ ডাউনলোড করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলে ৭ দিনের জন্য ২০০০ টাকা (সর্বনিম্ন) ঋণের আবেদন করা যায়। পরিশোধের পর ধাপে ধাপে ঋণের সীমা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত যায়।
নিজেদের কোনো অফিস বা ঠিকানা না থাকলেও র্যাপিড ক্যাশ আবেদনের সময় একজন গ্রাহকের এনআইডি, ছবি, বর্তমান ঠিকানা, দুজন জিম্মাদারের বিস্তারিত তথ্য, অফিসের নাম, পদ, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ বহু তথ্য নিয়ে নেয়। এছাড়া অ্যাপটি ইনস্টল করলে একজন গ্রাহকের মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট ও ছবির গ্যালারির অ্যাক্সেস নিয়ে নেয় র্যাপিড ক্যাশ।
আমি র্যাপিড ক্যাশ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে নির্ধারিত সময় পরিশোধ করতে পারিনি। ৭৬ দিন পর তারা আমাকে ৮১৯৬ টাকা পরিশোধের ম্যাসেজ পাঠায়। অথচ ঋণ নেওয়ার সময় অতিরিক্ত সুদের বিষয়ে কিছু জানায়নি। টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা আমাদের সামাজিকভাবে হয়রানি করছে।
আশরাফুল আলম, র্যাপিড ক্যাশের গ্রাহক
জানা গেছে, ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় র্যাপিড ক্যাশের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে গ্রাহকের কখনো দেখা হয় না। সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় অ্যাপের মাধ্যমে। র্যাপিড ক্যাশ থেকে অনলাইনে ঋণের টাকা চলে আসে গ্রাহকের বিকাশ, নগদ কিংবা রকেট অ্যাকাউন্টে। তবে একজন গ্রাহককে ২ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে দেওয়া হয় ১৬৮৫ টাকা। কেটে রাখা হয় ৩১৫ টাকা।
আবেদন প্রক্রিয়াকরণ ফির নামে ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস চার্জ হিসেবে ১৮০ টাকা এবং ভ্যাট চার্জ হিসেবে ১৫ টাকা কেটে রাখে তারা। যদিও ঋণ নেওয়ার আগে টাকা কাটার বিষয়ে কোনো তথ্য গ্রাহককে জানানো হয় না। মাত্র ৫ টাকা সুদে ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের প্রাচীন মহাজনি প্রথার ফাঁদে ফেলে দিচ্ছে ঠিকানাবিহীন এই প্রতিষ্ঠান।
যাচাই করে দেখা গেছে, নির্ধারিত দিনে গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বা আরও কিছুদিন টাকা দিতে না পারলে শতকরা হিসেবে বার্ষিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয় র্যাপিড ক্যাশ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদ হারের প্রায় সাড়ে ৫ গুণ বেশি। এছাড়া ভ্যাটসহ আবেদন প্রক্রিয়াকরণের নামে তারা যে ফি নিচ্ছে তা বৈধ কোনো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান নেয় না।
র্যাপিড ক্যাশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা কিংবা ঋণ দেওয়ার কোনো অনুমোদন নেয়নি। লাইসেন্স ছাড়াই ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আইন অনুযায়ী গ্রাহকের আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদানের কোনো কার্যক্রম করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। র্যাপিড ক্যাশ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের লাইসেন্স দেয়নি।’
আশরাফুল আলম নামে একজন গ্রাহক বলেন, ‘আমি র্যাপিড ক্যাশ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে নির্ধারিত সময় পরিশোধ করতে পারিনি। ৭৬ দিন পর তারা আমাকে ৮১৯৬ টাকা পরিশোধের ম্যাসেজ পাঠায়। অথচ ঋণ নেওয়ার সময় অতিরিক্ত সুদের বিষয়ে কিছু জানায়নি। টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা আমাদের সামাজিকভাবে হয়রানি করছে। আমার দুই জিম্মাদারসহ বাবা-মা ও পরিবারের বেশ কয়েকজনকে ফোন দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করছে।’
শাহানা বেগম নামে আরেক গ্রাহক বলেন, আমার ৩ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ৩০ দিনের সুদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকার মতো। আগে থেকে আমাকে এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। আমি তাদের বলেছি এত টাকা দিতে পারব না। তখন তাদের একজন আমাকে ফোন করে বলে, ‘যারা টাকা দেবে না তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে।’
বাংলাদেশের কোথাও র্যাপিড ক্যাশের কোনো অফিস বা দৃশ্যমান কার্যালয় নেই। নানাভাবে যোগাযোগ করেও তাদের কোনো অফিসের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক পদে কে আছেন তাও সবার অজানা। শুধু তাদের ওয়েবসাইটে একটি হটলাইন নম্বর (+8809613822040 ) দেওয়া আছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি কেটে যায়। কেউ ধরে না।
আইন অনুযায়ী গ্রাহকের আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদানের কোনো কার্যক্রম করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। র্যাপিড ক্যাশ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের লাইসেন্স দেয়নি।
মো. মেজবাউল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক
ফোন করে কোনো ঠিকানা পাননি গ্রাহকরাও। সাদেক হাসান নামে একজন গ্রাহক বলেন, র্যাপিড ক্যাশে সুদের বিষয়ে জানতে তাদের অফিসে যাওয়ার ইচ্ছা থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। কেউ ফোন ধরেনি। তবে টাকা চাওয়ার জন্য দুই দিন দুটি ভিন্ন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। সেগুলোতে পরবর্তীতে কল ব্যাক করে বন্ধ পাওয়া যায়।
চলতি বছরের জুনে র্যাপিড ক্যাশ থেকে ঋণ নেওয়ার পর ফেরত দিতে বিলম্ব করায় এক গ্রাহক ও তার পরিবারের লোকজনকে হুমকি দেয় প্রতিষ্ঠানটির লোকজন। এ ঘটনায় গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ভুক্তভোগী গ্রাহক।
জিডিতে ওই গ্রাহক উল্লেখ করেন, র্যাপিড ক্যাশ থেকে ফোন করে আমার কাছ থেকে সুদ হিসেবে যথাক্রমে ২৫০০, ৩৫০০ এবং সর্বশেষ ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় তারা আমার মোবাইলের অ্যাকসেস নিয়ে আমার স্ত্রী, মা ও বাবাকে ফোন দিয়ে হেনস্তা করেছে।আমার শ্বশুরকে ফোন করে ৭৮ হাজার টাকা দাবি করেছে। সর্বশেষ তারা আমাকে খুন করে আমার স্ত্রীকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।