অনিবন্ধিত মোবাইল সেট ও সিম কার্ড রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এসব সিম ও সেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক প্রপাগান্ডা, সরকারবিরোধী প্রচারণা ও উগ্রবাদ ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে স্বার্থান্বেষী মহল। শুধু তাই নয়, নানা রকম ডিজিটাল অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে।
মূলত মোবাইল অপারেটরদের ডিলাররা অতিরিক্ত লোভ ও লাভের আশায় এখনো ভুয়া নাম-ঠিকানায় সিম রেজিস্ট্রেশন করছে। আর বিদেশ থেকে চোরাই পথে আসা মোবাইল সেটের কারণে সরকার শত কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার অপরাধ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু অপরাধীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলো অনিবন্ধিত সেট ও সিম। এছাড়াও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারগুলোর (আইএসপি) লগ সংগ্রহে না রাখা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলার নেপথ্যেও এসবের ভূমিকা রয়েছে।
চোরাই পথে আসা অনিবন্ধিত সেটগুলো ক্লোন আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন) নম্বরের মোবাইল সেট হিসাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর অনিবন্ধিত বা ভুয়া ঠিকানায় নিবন্ধিত সিম কার্ডগুলো নজরদারি সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ বিধায় সাইবার অপরাধীরা এর সুযোগ নিচ্ছে।
অনিবন্ধিত সিম ও সেটের বিস্তার সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিটিআরসি শতভাগ সিম কার্ড নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করলেও কোনো কোনো মোবাইল অপারেটরের ডিলার অতিরিক্ত লোভ ও লাভের আশায় এখনো ভুয়া নাম-ঠিকানায় সিম রেজিস্ট্রেশন করছে। আর একটি চক্র ব্যাগেজ সুবিধায় বিদেশ থেকে শুল্ক ছাড়া সেট আনছে। এ কাজে কাস্টমস সহযোগিতা করছে। এসব সেট অনলাইনে এবং মোবাইল মার্কেটে হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে।
এতে সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের বৈধ মোবাইল ব্যবসা ও মোবাইল উৎপাদন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশ থেকে সেট এনে অনিবন্ধিত অবস্থায় ব্যবহার করা হচ্ছে-যা পরবর্তীতে ক্লোন ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিটিআরসির কমিশনার (স্পেকট্রাম) প্রকৌশলী একেএম শহীদুজ্জামান বলেন, অনিবন্ধিত সেটের বিস্তার রোধে পহেলা জুলাই বিটিআরসির ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টেটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) সিস্টেমের উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ডাটাবেজে ৩০ জুনের আগ পর্যন্ত সব মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর কেউ অনিবন্ধিত সেট কিনলে এনইআইআর ডাটাবেজে রেজিস্ট্রেশনের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলে ম্যাসেজ চলে যাবে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যবহারকারীরা ৩ মাস সময় পাবেন। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন না করলে সেটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, অনিবন্ধিত সেটের দৌরাত্ম্য বন্ধে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে চোরাই পথে মোবাইল আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্তমানে ব্যবহৃত ১০ কোটি মোবাইল সেটের মধ্যে ৩০ শতাংশই অবৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপরাধ সংগঠনের জন্য নকল আইএমইআই নম্বরের সেট বা ক্লোন সেট বা অনিবন্ধিত সেট নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে সরকার প্রতিবছর শতাধিক কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
অনিবন্ধিত সেটের মাধ্যমে অপরাধ বন্ধে যুক্তরাজ্য ২০০২ সালে মোবাইল টেলিফোন রি-প্রোগ্রামিং আইন প্রণয়ন করেছে। ফিলিপাইনও একই ধরনের আইন করেছে। ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড সব অপারেটর ও গ্রাহকদের সিইআইআরের (সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টেটি রেজিস্ট্রারি) মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক রেজওয়ানুল হক বলেন, বর্তমানে ১৪টি প্রতিষ্ঠান দেশে মোবাইল ফোন সেট উৎপাদন করছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম। বরং পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা দিয়ে উৎপাদন করলে মোবাইল অবিক্রিত বা উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। এ অবস্থায় অনিবন্ধিত সেটের জন্য উৎপাদনকারীরা চরম বেকাদায় পড়েছে। কারণ ফোন উৎপাদনের ১৮ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু ব্যাগেজে আনলে কোনো ট্যাক্সই দিতে হয় না। এই গ্রে ফোন ৩০ শতাংশ বাজার দখল করে রেখেছে। তাই শিল্পের স্বার্থে অনিবন্ধিত ফোন বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।