অ্যান্টিবায়োটিকের মহাবিপদ মোকাবিলায় কার কী করণীয়

।। বিশেষ প্রতিনিধি ।।

শরীরে কোনো সমস্যা হলে এখন আর আগের মতো সমস্যা নেই। আছে অ্যান্টিবায়োটিক। একটা খেলেই সমস্যা দূর। আর দু, তিনটে খেলে তো এই রোগ জীবনে কখনো হবেই না। অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিককে এভাবে দেখে থাকেন, ফলে এর যথেচ্ছ ব্যবহারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এজন্যই দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খান ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করেন না। কেউ এগুলো পাত্তা দেন না, কেউ আবার এ সম্পর্কে সঠিক বিধি জানেন না। আসলে ব্যাপারটা কী? অ্যান্টিবায়োটিক কিভাবে খেতে হবে? কী বলেন চিকিৎসক ও গবেষকরা?

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলে থাকেন, মানুষের শরীরের অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার বা কোর্স শেষ না করার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এমনিতেই বাতাসে নানা ধরণের জীবাণু, ভাইরাস থাকে; সেগুলো প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। যেকোনো রোগে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, ‘নো মেডিকেশন ইজ বেটার দ্যান সেলফ মেডিকেশন!’ তাই কিছু হলেই ওষুধ না খেয়ে বরং শুশ্রুষা করুন, শরীরকে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সময় ও সুযোগ দিন।

সম্প্রতি সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসি (সিডিডিইপি)–র এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে গোটা বিশ্বে বছরে ৭ লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কেবল পাশের দেশ ভারতেই প্রতি বছর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে মারা যায় ৫৮ হাজার শিশু। এমন সমীক্ষার ফল দুশ্চিন্তায় ফেলেছে চিকিৎসকদের।

ওয়ান হেলথ বাংলাদেশ-এর সিনিয়র কারিগরি উপদেষ্টা ও পশু চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. নিশিথ সি দেবনাথ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, অকারণে এবং অতিরিক্ত ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পাওয়ার তৈরি হওয়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি লোক মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবে। পশু চিকিৎসায়ও যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে। এসব পশুর মাংস ও দুধ খাচ্ছে মানুষ। পশুর মাংস খাচ্ছে বিভিন্ন পাখিও। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকৃতির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

antibiotic

চিকিৎসকরা বলছেন, অসুখের শুরুতেই কড়া মাপের অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করলে অসুখ সহসাই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অনিয়ম করা হলে জীবাণুগুলো কিছু দিন ঝিমিয়ে থাকে এবং কিছু দিন পর ঠিকই তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে সময় আর ওই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে কাজ করে না। কারণ অসুখের জীবাণু ততদিনে অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার শক্তি তৈরি করে ফেলেছে। এই অবস্থাকে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বলে। রেজিস্ট্যান্সি বা জীবাণুর এই প্রতিরোধী শক্তির কারণে গবেষকদের এখন অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে নতুন কিছু খুঁজতে হচ্ছে। যক্ষ্মার জন্য বাজারে পাঁচ-ছ’টি ওষুধ মিললেও ব্যবহারের অনিয়মের কারণে আজকাল অনেক রোগীর শরীরেই পুরনো এসব অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার প্রসঙ্গে আলাদা প্রশিক্ষণ দরকার। জনগণকে সচেতন করতেও দরকার নানামুখী কর্মসূচি। ‘সঠিক পরিমাণ’ ও ‘সঠিক মাত্রা’- অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ক্ষেত্রে এই দুটো বিষয়ে কোনো ভুল করা চলবে না। রোগী ও চিকিৎসকদের এসব বিষয়ে সহযোগিতা দিতে হবে রাষ্ট্রকে। কারণ এটা এখন সারা দেশের জন্য এক মহাবিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। উন্নত বিশ্বে প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনোভাবেই ওষুধ কেনা নিষিদ্ধ, অ্যান্টিবায়োটিকের কথা তো চিন্তাই করা যায় না। সেখানে আমাদের দেশে আলু-পটলের মতো দোকান থেকে কেউ চাইলেই অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে নিচ্ছেন। এটা সরকারি নীতিরই ব্যর্থতা। সমস্যা সমাধানে সরকারকে দ্রুত সঠিক পদক্ষেপসমেত এগিয়ে আসতে হবে।

চিকিৎসকের করণীয়

    • প্রত্যেক চিকিৎসকের উচিৎ অ্যান্টিবায়োটিক এড়িয়ে সাধারণ ওষুধই প্রথমে ব্যবহার করা
    • প্রথমেই কড়া মাপের অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে নির্দিষ্ট প্রোটোকল মেনে ওষুধ দেওয়া
    • রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা

রোগীর করণীয়

        • চিকিৎসক শুরুতেই কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিলে তার চিকিৎসাজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ করুন, অন্য চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করুন
        • নিয়ম মেনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করুন, কোনো রকম হেলাফেলা এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়
        • অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময় নিয়ম করে দু’-তিন লিটার পানি পান করুন। বেশি পানি খেতে সমস্যা হলে ফলের রস, ডালজাতীয় খাবার খান
        • অ্যান্টিবোয়োটিক খেলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সঙ্গে অ্যান্টাসিড ও ভিটামিন খান
        • অ্যান্টিবায়োটিক খেলে হজম ক্ষমতা কিছুটা কমে, তাই সহজপাচ্য খাবার খান। তেলমশলা জাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে হজম সহায়ক খাবার খান

সরকারের করণীয়

      • অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন
      • চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দান
      • রোগীকে সচেতন করা
      • দেশব্যাপী নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রশাসনসহ অন্যদের সক্রিয় করা