।। বিশেষ প্রতিনিধি ।।
দীর্ঘদিন ধরেই ‘জাতিগত একতা’ নীতির বদৌলতে জাপানের অভিবাসন আইন অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু শিল্পোন্নত দেশটির বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন আছে। এতদিন প্রধানত চীন থেকেই তারা দক্ষ জনবলের জোগান পেত। কিন্তু স্থানীয় চাহিদার কারণে ইদানীং চীন সরকার বিদেশে শ্রমিক প্রেরণে অনুৎসাহ দিচ্ছে এবং চীনা শ্রমিকরা বিদেশে বেতনও বেশি দাবি করছে।
শ্রমিক সংকটের এই পর্বেই জাপানে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শ্রমিকের বিরাট চাহিদা। ২০১৯ সালের রাগবি বিশ্বকাপ, ২০২০ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, প্যারা অলিম্পিক ও ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজক দেশ হওয়া, নিজ দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং নতুন যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার কারণে বিপুল শ্রমিকের অভাব বোধ করছে এশিয়ার উন্নত দেশটি।
শ্রমিকের চাহিদা পূরণে জাপান তাই বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করতে অভিবাসন আইনে পরিবর্তন আনছে। সম্প্রতি এ বিষয়ক একটি খসড়া আইন অনুমোদন করেছে জাপানের মন্ত্রিসভা। এর আওতায় কর্মী সংকট আছে এমন সব খাত, বিশেষত কৃষি, নির্মাণকাজ এবং স্বাস্থ্যখাতে বিদেশি শ্রমিক নিতে পারবে জাপানি উদ্যোক্তারা। আইনটি এখন সংসদে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
খসড়া আইনে দুই ধরনের ভিসার কথা বলা হয়েছে। প্রথম ভিসা ক্যাটাগরিতে জাপানে যাওয়া শ্রমিকরা সেখানে ৫ বছর কাজ করতে পারবেন এবং পরিবার নিয়েও বাসবাস করতে পারবেন, যদি তাদের একটি নির্দিষ্ট মানের কাজ করার দক্ষতা থাকে এবং তারা জাপানি ভাষা কিছুটা আয়ত্ব করতে পারেন। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ভিসাতে জাপানে যাওয়ার সুযোগ পাবেন উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীরা। তাদেরকে সেখানে পরিবার-পরিজনসহ স্থায়ীভাবেও থাকার সুযোগ দেওয়া হবে।
জাপানের শ্রমিক চাহিদা ও এ বিষয়ক নতুন আইন প্রণয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশটির শ্রমিক ঘাটতির খবর গুরুত্ব পায় ২০১৫ সালে, যখন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া থেকে জনশক্তি আমদানির ব্যাপারে জাপান সরকারের সবুজ সংকেত মেলে।
বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার সে সময় জানান, বাংলাদেশ থেকে জাপান যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিতে আগ্রহী, সেই সংখ্যাটা মোটেও ১০ হাজারের নিচে নয়। তিনি জানান, আগে মাত্র ৩০টি পেশায় বাংলাদেশিরা চাকরি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেও এই পর্যায়ে সব মিলিয়ে ৭৭টি পেশাকে বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তখন জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে খোলা হয় একটি শ্রম শাখা।
কিন্তু ৩ অক্টোবর ২০১৫ দেশের মাটিতে জাপানি নাগরিক কুনি হোশিও হত্যার পর চিত্রপট একেবারেই পাল্টে যায়। বাংলাদেশ ভ্রমণে বিশেষ সতর্কতা জারি করে জাপান সরকার। এই পরিস্থিতির আঁচ কাটিয়ে উঠতে না উঠতে মাত্র ৯ মাসের মাথায় ১ জুলাই ২০১৬ হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় অন্যদের পাশাপাশি নিহত হন জাপানের সাত নাগরিক। এরপর থেকে অনেক জাপানির কাছে বাংলাদেশ হয়ে যায় ‘আইএস আক্রান্ত রাষ্ট্র’। স্বাভাবিকভাবেই জাপানিদের বাংলাদেশ ভ্রমণে আরও কড়াকড়ি আরোপ হতে থাকে। জাপান সরকার বাংলাদেশগামী জাপানিদের পরামর্শ দেয়ার জন্য বিশেষ শাখা গঠন করে। সব কিছু মিলিয়ে স্তিমিত হয়ে আসে জনশক্তি রপ্তানি কার্যক্রম।
জাপানে কর্মসংস্থানের দরজা খুলে যাওয়াটা বিরাট অর্জন হবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশের চেয়ে জাপানে আয়ের সুযোগ বেশি, আর সেখানকার কর্মপরিবেশও স্থিতিশীল। জাপান ফেরত শ্রমিকরা দেশে এসেও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু সেখানকার শ্রমবাজারে প্রবেশের ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে নানা মহলের অভিযোগ রয়েছে।
জাপান সরকারের আরোপিত ভ্রমণ সতর্কতা দ্রুতই উঠে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার অনেক আগে থেকেই আশাবাদী। কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। এখনও ওই সতর্কতা বহাল রয়েছে। এদিকে জাপানি কিছু গবেষক দল ও সরকারি পর্যায় থেকেও বাংলাদেশ সফর হচ্ছে। বাংলাদেশে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়, জাপানি উদ্যোক্তারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান। কিন্তু বাংলাদেশকেই এক্ষেত্রে আস্থা ও নির্ভরতার জায়গা সৃষ্টি করতে হবে। আর সেটা করতে হবে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই।