ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: মেট্রোরেলের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কলকাতা থেকে ঢাকায় মেট্রোরেলের ভাড়া অনেক বেশি। এতে করে যাত্রীস্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে ব্যাহত হবে মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতারা কলকাতায় মেট্রোরেলের ভাড়া ও ঢাকায় মেট্রোরেলের ভাড়ার একটি চিত্র তুলে ধরেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি বা ৬ টাকা। আর ঢাকায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। এছাড়া কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ভাড়া ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা। আর ঢাকায় মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা।
কিলোমিটারের হিসাব তুলনা করে বলা হয়, কলকাতায় ৫ রুপি বা ৬ টাকা দিয়ে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। আর ১০ রুপিতে যাওয়া যায় পাঁচ কিলোমিটার, ১৫ রুপিতে ১০ কিলোমিটার, ২০ রুপিতে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা লাগে।
অন্যদিকে ঢাকায় মেট্রোরেলের কিলোমিটারের ভাড়ার হিসাব তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা, যা কলকাতার মেট্রোরেলের চেয়ে চারগুণ বেশি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির মেট্রোতে একই দূরত্বে ৪০ রুপি বা ৫০ টাকা লাগে, যা ছুটির দিনে ৩০ রুপিতে নেমে আসে। দিল্লির মেট্রোতে ৩২ কিলোমিটার পথে ৬০ রুপিতে যাতায়াত করা যায়।
পাকিস্তানের মেট্রোরেলের ভাড়ার বিষয়ে বলা হয়, লাহোরে অরেঞ্জ লাইন মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া পাকিস্তানি ২০ রুপি বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ টাকা। ২৭ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ৪০ রুপি বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ টাকা লাগে। লাহোরের মেট্রোতে প্রথম চার কিলোমিটার ২০ রুপি বা ৯ টাকা। পাঁচ কিলোমিটার থেকে আট কিলোমিটারের জন্য ২৫ রুপি বা ১১ টাকা, ৯-১২ কিলোমিটারের জন্য ৩০ রুপি বা ১৪ টাকা লাগে। ১৩-১৬ কিলোমিটারের জন্য ৩৫ রুপি বা ১৬ টাকা লাগে। ১৬-২৭ কিলোমিটারের জন্য ৪০ রুপি বা ১৮ টাকা লাগে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকা ও কলকাতা শহরের সামাজিক অবস্থা, মাথাপিছু আয় এবং গড় জিডিপি বিবেচনায় নিলে দেখা যায় প্রায় সব সূচকে সমান অবস্থানে দুটি শহর। কিন্তু কলকাতার মেট্রোরেলের তুলনায় ঢাকার মেট্রোরেলে ভাড়া দ্বিগুণ। আর সর্বনিম্ন ভাড়া চার গুণ বাড়তি। এতে করে যাত্রীস্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর বেসরকারি লক্কড়-ঝক্কড় বাস কোম্পানিগুলো হবে লাভবান। সামর্থ্যহীন যাত্রীরা মেট্রোরেল ব্যবহারের সক্ষমতা হারাবে।
বাংলাদেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় কলকাতা থেকে বেশি বলে জানান সমিতির মহাসচিব। এসময় তিনি এশিয়ার কয়েকটি মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়ের উদাহরণ তুলে ধরেন।
মেট্রোরেলের ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির
তিনি বলেন, ২০১৩-১৯ সালের মধ্যে নির্মিত ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার নর্থ-সাউথ মেট্রোরেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১১-২১ সালের মধ্যে নির্মিত ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরে লাইন-২ এ মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। ভারতের দিল্লি লাইন-১ মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১৫-২০ সালে নির্মিত পাকিস্তানের লাহোর অরেঞ্জ মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ ৬ কোটি ৬১ লাখ ডলার।
অন্যদিকে সমিতির মহাসচিব জানান, ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয়েছে বেশি। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তরা থেকে কমলাপুর ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ হচ্ছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের পরিবর্তে কেন এত উচ্চমূল্যে মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হচ্ছে যাত্রীসাধারণ তা জানতে চায়।
তিনি আরও বলেন, একদিকে মেগা প্রকল্পগুলোতে বেহিসেবি খরচ, অন্যদিকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলো খালি করে দিচ্ছে। এর মাসুল দিতে হচ্ছে জনগণকে।
প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বলেন, অনভিজ্ঞ লোকজনকে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়ায় কোনো প্রকার সমীক্ষা বা গবেষণা ছাড়াই সর্বোচ্চ ব্যয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে আশপাশের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে মেট্রোরেলের ভাড়া বাসের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে ২-৫ গুণ পর্যন্ত বেশি বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসময় গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও এফবিসিসিআইএ’র সাবেক পরিচালক আবদুল হক বেশ কয়েকটি দাবি জানান।
এগুলো হলো- মেট্রোরেলের বিদ্যমান ভাড়া কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত যাত্রীদের মাসিক কার্ডে বিশেষ সাবসিডি প্রদান, বন্ধের দিনে আকর্ষণীয় ভাড়া নির্ধারণ, মেট্রো থেকে নামার পর হাঁটার পরিবেশ তৈরির জন্য ফুটপাত পরিষ্কার রাখা, কানেক্টিং রোডে পর্যাপ্ত বাস ও অন্যান্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা রাখা, বিশেষ বিশেষ স্টেশনগুলোতে কার ও বাইসাইকেল পার্কিংয়ের র ব্যবস্থা রাখা এবং মেট্রোরেলের পরিচালনা পরিষদে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব রাখা।