ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজধানীর বিমানবন্দরে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের অব্যবস্থাপনা বেড়েছে। লাগেজ পেতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। একটি ফ্লাইটের লাগেজ সরবরাহ করতে ৬০ মিনিট সময় নির্ধারিত থাকলেও যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে লাগেজ পেতে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছেন বয়স্ক, নারী-শিশু এবং অসুস্থ যাত্রীরা।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিমানবন্দরের লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন কর্তৃপক্ষ বলছে সহসা লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে সমস্যা দূর হবে না।
দেশের বিমানবন্দরগুলোতে একক ভাবে হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন প্রায় ২৭টি এয়ারলাইন্সের ১৪০ থেকে ১৫০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। দিনে প্রায় ২২ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। বিদেশি এয়ারলাইনগুলো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে চার্জ দেয়। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খাতে বিগত ৩ বছরে বিমানের আয় ছিল ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এটি বিমানের আয়ের অন্যতম খাত হলেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম নেই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নেই মনিটরিং।
সূত্র জানায়, ২৪ ঘণ্টায় শিফট ভিত্তিতে বিমানবন্দরে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করেন কর্মীরা। তবে ফ্লাইটের সংখ্যা বিবেচনা করে কর্মীদের শিডিউল করা হয় না। ফলে যখন একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট বিমানবন্দরে আসে, তখন দায়িত্বে থাকা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের নেই আধুনিক গাড়ি ও যন্ত্রপাতি। বিমানের কাছে থাকা যন্ত্রপাতি প্রায় সময় বিকল হলে লাগেজে ডেলিভারি দিতে বেশি সময় লাগে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কর্মীদের শিফট পরিবর্তনের সময় ঘটে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ।
শিফটের সময় শেষ হলে কর্মীরা লাগেজ ফেলে চলে যান, অন্যদিকে নতুন শিফটের কর্মীরা না আসা পর্যন্ত বন্ধ থাকে কার্যক্রম। যে কারণে ক্ষুব্ধ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় হ্যান্ডলিং চার্জ বেশি নিলেও মানসম্মত সার্ভিস দিচ্ছে না বিমান। বরং বিমানের কারণে এয়ারলাইনগুলোকে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে। বিমান রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হওয়ায় যাত্রীদের অভিযোগ নিয়ে নানা রকম কমিটি আর বৈঠক হলেও কার্যকর সুফল আসেনি। বিমানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
শামিম ইসলাম গত ২৭ জুন বাহরাইন থেকে গালফ এয়ারের (GF 0250) ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন। তার বাড়ি সিলেট হওয়ায় সে দিন সকাল ৮টার দিকে ঢাকা থেকে সিলেটগামী ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গালফ এয়ারের বিমানে ভোর ৬টায় অবতরণ করলেও লাগেজ পেয়েছেন সকাল ৮টার পর। লাগেজ পেতে দেরি হওয়ায় সিলেটগামী ফ্লাইট মিস করেন শামিম।
শামিম ইসলাম বলেন, ‘আমার সকাল ৮টায় ইউএস বাংলার ফ্লাইটে সিলেটে যাওয়ার টিকিটে কাটা ছিল। কিন্তু লাগেজের জন্য যেতে পারিনি। আমি আবার নতুন করে টিকিটে কেটে সিলেট গিয়েছি। আমার ক্ষতি হলো, আমি ক্ষতিপূরণ কার কাছে চাইবো, এই অব্যবস্থাপনা কবে দূরে হবে।’
বিমানবন্দরে লাগেজ সরবরাহের দেরি হওয়া নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে কাতার প্রবাসী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা খুবই খারাপ। আমার লাগেজ পেতে ৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে। কাতার এয়ারওয়েজের (Qr 640) ফ্লাইটে ১৭ জুন ঢাকায় রাত ২টা ১০ মিনিটে এসেছিলাম। বাইরে আমার পরিবারের লোকজন অপেক্ষা করছিলো। সাড়ে ৫ ঘণ্টায় কাতার থেকে চলে আসলাম। আর লাগেজের জন্য আমাকে ৩ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। লাগেজ বেল্ট জোনে বসার ব্যবস্থা নেই, একটু পানি পান করবো, সেই ব্যবস্থা নেই। একটা বিমানবন্দর বছরের পর বছর ধরে একই রকম অব্যবস্থাপনায় চলছে, দেখার কেউ নেই।’
একই রকম খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে এনামুল হকের। তিনি বলেন, ‘আমি ৩০ জুন মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সে এসেছি। আমাদের ফ্লাইট রাত ১টার দিকে অবতরণ করে। ৩০ মিনিটের মতো সময় লেগেছে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে। কিন্তু লাগেজের পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমরা লাগেজ পেয়েছি।’
সৌদি আরব প্রবাসী বিপ্লব আহমেদ বলেন, ‘আমি ০১ জুলাই বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ঢাকায় আসি সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে (SV808)। লাগেজ পাই ২টার পরে। যারা লাগেজে ডেলিভারির দায়িত্বে আছেন, তারা আসলে আমাদের প্রবাসীদের মানুষ মনে করেন কি না সন্দেহ।’
১৬ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় লাগেজ ডেলিভারির অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী হ্যান্ডলিং কার্যক্রম যথাযথ ভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে জনবল ও ইকুইপমেন্ট বাড়াতে নির্দেশনা দেন। লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সময়সীমা ৬০ মিনিটের নিচে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তবে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল সভায় জানান, সহসা লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে সমস্যা দূর হবে না।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে চার/পাঁচটি ফ্লাইট অবতরণ করলে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে অসুবিধা হয়। সময় বেশি প্রয়োজন হয়। একটি ফ্লাইটের ব্যাগেজ শেষ করে আরেকটি ফ্লাইটের মালামাল দিতে হয়। তৃতীয় টার্মিনাল চালু না হওয়া পর্যন্ত লাগেজ বেল্ট বাড়ানো হলেও সমস্যা থাকবে। বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাপেক্ষে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সময়সীমা ৬০ মিনিট থেকে কমিয়ে আনার বিষয়টি ভবিষ্যতে কার্যকর করা সম্ভব হতে পারে। সভায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান লাগেজ হ্যান্ডলিং কার্যক্রম যথাযথ ভাবে মনিটরিং/সমন্বয়ের জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগের পরামর্শ দেন।
০৩ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সরকারি সফর শেষে পর্তুগাল থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট এলাকায় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের অভিযোগ শোনেন। যাত্রীদের দেরিতে লাগেজ পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার যাত্রী বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। ১৪০-১৫০টি ফ্লাইট অপারেট হচ্ছে। আমাদের বিমানবন্দরে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে যারা (বিমান) আছেন তারা চেষ্টা করেন ১৮ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি দিতে। বেশির ভাগ যাত্রীরা ৬০ মিনিট কিংবা ৬৫ মিনিটের মধ্যে লাগেজ পেয়ে যান। মাঝে মাঝে বিভিন্ন কারণে কিছুটা দেরি হয়। কিন্তু সাধারণত এতো দেরি হয় না। বাংলা ট্রিবিউন।