ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজধানীর বারিধারায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পূর্ব-উত্তর কোণ থেকে গুলশান-২ গোল চত্বরের দূরত্ব গুগল ম্যাপ অনুযায়ী এক কিলোমিটারের কম। ঢাকার ডিজেল চালিত যেকোনো গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। আর প্রতি কিলোমিটারের হিসাব ধরলে সেটা ২ টাকা ৪৫ পয়সা। কিন্তু এসি বাসগুলোতে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। অর্থাৎ সাধারণ বাসের তিনগুণ। এ বিষয়ে সরকারের কোনো নীতিমালাও নেই।
শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক তথা পুলিশ প্লাজা থেকে গুলশান-১ গোল চত্বরের দূরত্বও প্রায় এক কিলোমিটার। সেখানেও নেওয়া হচ্ছে একই ভাড়া। একই ভাবে কেউ যদি গুলশান-২ থেকে বারিধারায় যেতে চায়, তখনও তার কাছ থেকে ২৫ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন এলাকায় বাস ভাড়ায় এমন স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকা নামে দুটি পরিবহন। যাত্রীদের অভিযোগ, এই রুটে ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকা ছাড়া বিকল্প গণপরিবহন নেই। বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। আর সরকার সাধারণ গণপরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ধার্য করলেও এসি বাসের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়নি। ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকা যাত্রীদের জিম্মি করে এই সুযোগটাই নিচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকার মালিকপক্ষের দাবি, তারা দেশের অভিজাত এলাকায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস দিয়ে চক্রাকার আকারে যাত্রী সেবা দিচ্ছেন। এসি বাস পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি। তাই তারা সাধারণ বাস থেকে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। তখন অভিজাত এলাকায় নিরাপত্তার অজুহাতে গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন এলাকায় যাত্রী পরিবহনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঢাকা চাকার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে ঢাকা চাকার ৩৫ আসনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১০টি বাস ছিল। পরে তারা আরও ২০টি গাড়ি নামায়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হিমাচল পরিবহন চালু করে ‘গুলশান চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরেকটি বাস সার্ভিস। বর্তমানে দুটি কোম্পানির আওতায় এসব রুটে শতাধিক বাস রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮০টি বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুরু থেকেই ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকার বাস ভাড়া নিয়ে যাত্রী অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। তখন যে কোনো দূরত্বের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। সেই ভাড়া ৮ বছরে দ্বিগুণ করা হয়েছে, যা দেশের অন্য রুটে এসি বাসের ভাড়ার তুলনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এসি ও আরামদায়ক বাসে কিছুটা বাড়তি ভাড়া থাকাটা স্বাভাবিক হলেও স্বল্প দূরত্বের এসব রুটে যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন যাত্রীরা।
দেশে গণপরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ সংস্থাটিই সাধারণ গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে। তাদের নির্ধারিত সর্বনিম্ন বাস ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু অভিজাত এলাকা বা দেশের অন্য রুটে এসি বাসে বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় না। আইনে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ভাড়া নির্ধারণে মালিকদের স্বাধীনতা দেওয়া আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই কোনো নোটিশ ছাড়াই যখন-তখন ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
গুলশান-বনানীর রুটগুলোর ভাড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গুলশান-১ থেকে ২ এর দূরত্ব ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এখানে সাধারণ পরিবহনের ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। বনানী থেকে নতুনবাজার বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এই পথে যাতায়াত করলে ভাড়া লাগে ৩০ টাকা। তবে কেউ যদি গুলশান-২ এ নেমে আবার নতুনবাজার যান তাকে গুনতে হবে ৫৫ টাকা। গুলশান-১ থেকে নতুনবাজার পর্যন্ত আবার ভাড়া দিতে হবে ২৫ টাকা।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ এ যাওয়ার জন্য ঢাকা চাকার একটি বাসে ওঠেন বেসরকারি চাকুরে লাবনী আক্তার। এ পথে তার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৩০ টাকা। আলাপকালে লাবনী আক্তার জানান, বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় তার বাসা। কিন্তু অফিস গুলশান-২ এ। এই পথে নিয়মিত বাসেই যাতায়াত করেন তিনি। কিন্তু বাস ভাড়া অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ এর দূরত্ব অনুযায়ী এসি বাসে সর্বোচ্চ ভাড়া ২০ টাকা হতে পারতো। কিন্তু পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা নিচ্ছেন ৩০ টাকা। আর বিকল্প গণপরিবহন না থাকায় এসব বাসেই বেশি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে।’
রামপুর থেকে হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি দিয়ে পুলিশ প্লাজা এলাকায় ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকার কাউন্টারের সামনে আসেন বেসরকারি চাকুরে ইকরাম উদ্দিন। তারপর ৩০ টাকা টিকিট কেটে গুলশান চাকায় ওঠেন। নামেন গুলশান-২ নম্বর কাউন্টারের সামনে। ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইকরাম উদ্দিন বলেন, ‘যানজট না থাকলে পুলিশ প্লাজা এলাকা থেকে গুলশান-১ এ আসতে দুই মিনিটের বেশি লাগে না। অথচ এটুকু দূরত্বের বাস ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। বিকল্প কোনো পরিবহন না থাকায় বাধ্য হয়েই এ বাসে যাতায়াত করতে হয়।’
বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকা থেকে গুলশান-২ এ নিয়মিত যাতায়াত করেন বনানী ১৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা মকবুল ইসলাম। তিনি বলেন, গুগল ম্যাপ অনুযায়ী এ পথের দূরত্ব ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার। বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী তা ৫ টাকার মতো হয়। আর বিআরটিএর সর্বনিম্ন ভাড়া যেহেতু ১০ টাকা, সেই হিসাবে এই পথের ভাড়া ১৫ হতে পারে। কিন্তু ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকা ৩০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে। এটা যাত্রীদের ওপর জুলুম ছাড়া কিছুই নয়।’
তিনি বলেন, ‘গুলশান-বনানী বা বারিধারা ঢাকার মধ্যে অভিজাত এলাকা। কিন্তু এ এলাকার ধনীরা কিন্তু বাসে যাতায়াত করেন না। নিম্ন আয়ের বা মধ্যবিত্ত যারা এই এলাকাগুলোতে চাকরি, ব্যবসা করেন তারাই বাসে যাতায়াত করেন। ফলে কম আয়ের মানুষের জন্য এসব পরিবহনে চলাচল করা খুবই কষ্টের। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।’
ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চাকার চেয়ারম্যান মন্টু মিয়া বলেন, ‘এসি বাসে ডাবল ইঞ্জিন থাকে। এর একটিতে গাড়ি চলে। আরেকটি এসি চালাতে ব্যবহার করা হয়। এতে গাড়ি চালাতে অনেক খরচ হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় পরিবহন শ্রমিকদেরও বাড়তি খরচ লাগে। এছাড়া আগে শিক্ষার্থীদের জন্য ফুল ভাড়া থাকলেও এখন অর্ধেক ভাড়া নেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘গুলশান, বনানী এলাকায় এখন সারাদিনই যানজট থাকে। আগে যেখানে একটি বাস দিনে ১৫টি ট্রিপ দিতো, এখন সেখানে ৮টির বেশি দিতে পারে না। তারপরও প্রতিটি কাউন্টারে একটির পর একটি বাস যাচ্ছে। যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে না। ফলে সড়কের দূরত্ব কম মনে হলেও এসি বাস পরিচালানায় ভাড়া কিছুটা বেশি নিতে হয়।’
দেশে গণপরিবহনে যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গুলশান, বনানীতে এসি বাসের নামে যে পরিমাণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা কোনো ভাবেই যৌক্তিক নয়। তারা যাত্রীদের জিম্মি করে গলাকাটা ভাড়া নিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির এসি বাসে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া ২ টাকা ৫০ পয়সা। সে অনুযায়ী ঢাকা চাকা, গুলশান চাকা যেহেতু বেসরকারি কোম্পানি তারা দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি নিতে পারে। কিন্তু তারা তা না করে নিজেদের মতো করে ভাড়া নির্ধারণ করছে। আর বিআরটিএ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) মো. লোকমান হোসেন মোল্লা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জাগো নিউজ।