ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: খুলনা থেকে বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পর্যন্ত নির্মিত রেলপথ উদ্বোধন করা হয়েছে। বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
এর মধ্য দিয়ে মোংলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রানজিট সুবিধার আওতায় মোংলা বন্দর থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধনের পর এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অগ্রগতি আরও বাড়বে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান এবং বিকাশ ঘটবে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পেরও। বাড়বে সরকারি রাজস্ব। রেলপথে পণ্য পরিবহনে কমবে খরচ।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে সেটা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে খুলনা-মোংলা রেললাইন চালুর মধ্য দিয়ে। প্রাণ পাবে মোংলা ইপিজেড। নতুন নতুন শিল্পোদ্যোক্তরা আসবে এ অঞ্চলে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, খুলনার সঙ্গে মোংলা বন্দরের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় এ বন্দরের সক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটান রেলপথ দিয়ে সহজেই মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। আগে সড়ক ও নদীপথে এ বন্দরের পণ্য পরিবহন হতো। তখন খরচ বেশি হতো। এখন রেলপথে পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে পণ্য মূল্যের ওপর।
এদিকে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুলনা-মোংলা রেললাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথে আরামদায়ক ভ্রমণের সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
খুলনা-মোংলা রেলপথের মাধ্যমে রেলওয়ের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়েকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আশা দেখছেন তারা।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল খুলনা-মোংলা রেলপথ। সে দাবি পূরণ হয়েছে। এই রেলপথের মাধ্যমে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, যেকোনো বন্দরের জন্য মাল্টিমডাল যোগাযোগ তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত দিন আমরা নদীপথে পণ্য পরিবহন করতে পেরেছি। পদ্মা সেতু হওয়ার পর সড়কপথে পরিবহন করা হচ্ছে। এবার রেলপথে পণ্য পরিবহন করা হবে। এই রেললাইনের ফলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে স্বল্প খরচে বিশেষ করে কনটেইনার পরিবহন করা যাবে। এতে করে বন্দরের ব্যবহারও বাড়বে। গার্মেন্টস পণ্য আমদানি ও রপ্তানি সহজতর হবে। এছাড়া বিদেশি প্রকোটল ব্যবহার করে খুলনা-মোংলা রেললাইন দিয়ে নেপাল-ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারবো। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে শিল্পায়ন গতিশীলতা পাবে। বাড়বে বন্দরের রাজস্ব।
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয়ও। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা থাকলেও কয়েক দফায় বেড়ে বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬০ কোটি টাকার বেশি। ভারত সরকারের ঋণসহায়তায় কনসেশনাল লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো ও ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। যার মোট প্রকল্প ব্যয় ৩৮৮ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার।
প্রকল্পের আওতায় রূপসা নদীর ওপর ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটারের রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৯০ কিলোমিটার রেলপথ। রেলপথটিতে রয়েছে নয়টি প্লাটফর্ম। ১০৭টি ছোট সেতু ও নয়টি আন্ডারপাসও নির্মাণ করা হয়েছে ওই প্রকল্পের আওতায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খুলনা-মোংলা রেল চালু হওয়ার ফলে ভারত, নেপাল ও ভুটান বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত হলো বাংলাদেশের সঙ্গে। এতে আরও গতিশীল হবে মোংলা বন্দর।
এই প্রকল্পে মোংলা বন্দর ও খুলনায় বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর মোংলা ব্রডগেজ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হলো।