কিন্তু এর আড়ালে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করছিল দেশি-বিদেশি অন্তত নয়টি ব্র্যান্ডের প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত নকল ঔষধ।
আটা-ময়দায় তৈরি এসব নকল ও ভেজাল ঔষধের মধ্যে রয়েছে ন্যাপ্রক্সেন প্লাস, প্যানটোনিক্স, গরু মোটাতাজার নিষিদ্ধ ঔষধ পেরিএকটিন, খোলা মাইজিদ- ৫০০ ট্যাবলেট।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার মিটফোর্ড, কুমিল্লার কাপ্তান বাজারের হিমালয় ল্যাবরেটরিজ এবং সাভারে প্রতিষ্ঠানটির গোডাউনে অভিযান চালায় ঢাকা মেট্রোপলিটন লালবাগের গোয়েন্দা পুলিশ।
অভিযানে প্রায় ২২ লাখ পিস ভেজাল ঔষধ জব্দ করা হয়। যা ডিবির পরিচালিত অভিযানে সর্বোচ্চ জব্দ করা ঔষধ। এ সময় ভেজাল ঔষধ তৈরি, বিপণন, মজুতের সঙ্গে জড়িত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- হিমালয় ল্যাবরেটরিজের মালিক মোর্শেদ আলম শাওন (৩৫), সাভার গোডাউনের কবির হোসেন (৪৪), কুমিল্লায় নকল ঔষধের ডিস্ট্রিবিউটর আল আমিন চঞ্চল (৩৫), নকল ঔষধ প্যাকেজিংয়ে জড়িত মো. নাজিম উদ্দিন (৪২), গোডাউন রক্ষণাবেক্ষণকারী মো. তৌহিদ (২৮)। এছাড়া গোডাউন ও ঔষধ তৈরি কারখানার অপারেটর ও শ্রমিক আইনুল ইসলাম (৩২), মো. সাগর (১৯), মো. আবির (২১), মো. রুবেল (২৩), মো. পারভেজ (৩২)।
ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠানগুলো নকল ও ভেজাল ঔষধ তৈরির দিকে ঝুঁকছে। যেভাবে ব্র্যান্ডের ঔষধ নকল ও ভেজাল হচ্ছে, এটা ভবিষ্যতে করোনার চেয়েও ভয়াবহ মহামারির আকার ধারণ করবে। তাই উচিত এখনই এর লাগাম টানা।
সোমবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, অভিযানে আমরা দেখতে পাই, প্রতিষ্ঠানটি দেশি-বিদেশি নয়টি ব্র্যান্ডের ঔষধ নকল করছে। জব্দ করা ঔষধের মধ্যে রয়েছে- ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যানটোনিক্স- ২০ এমজি নয় লাখ ১৮ হাজার ৪৫৬ পিস, স্কয়ারের সেকলো- ২০ চার লাখ ১০ হাজার ৪০০ পিস, দি একমি ল্যাবরেটরিজের মোনাস- ১০ ৫৮ হাজার ৫০ পিস, হেল্থকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্জেল ক্যাপসুল ৯৬ হাজার পিস, অপসোনিন ফার্মার ফিনিক্স- ২০ ৫৮ হাজার ৮০০ পিস, কুমুদিনি ফার্মার অ্যান্টিবায়োটিক দিজা (thiza) ছয় হাজার ২৪০ পিস, আমবে (Ambee)ফার্মাসিউটিক্যালসের Myzid- 500 ছয় হাজার ৪৮০ পিস, জেনিথের ন্যাপ্রক্সেন প্লাস ৪১ হাজার ৪০০ পিস, ব্রোনসন-ইউএসএ-এর জিবি- ৬০ তিন হাজার পিস।
‘অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ফয়েল পেপার দিয়ে সুন্দর করে এসব ঔষধ মোড়কজাত করছে। বোঝার কোনো উপায় নেই এটা আসল না নকল। এ ঔষধের গুণগত মান বলতে কিছুই নেই। আটা বা ময়দার সঙ্গে ক্যামিকেল মিশিয়ে তৈরি এসব নকল ঔষধ প্যাকেজিং করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমরা এসব ঔষধ পরীক্ষা করে দেখব কী পরিমাণ ক্ষতিকারক উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। আদৌ এর কোনো গুণগত মান আছে কি না!’
তিনি আরও বলেন, জব্দ করা ঔষধগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকারীদের জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করছে। বাংলাদেশে করোনার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে এসব ভেজাল অ্যান্টিবায়োটিক। দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত ঔষধ হচ্ছে ওমিপ্রাজল গ্রুপের গ্যাসের ঔষধ। যা এখন ব্যাপক হারে নকল হচ্ছে। এটা খুবই খারাপ বার্তা দিচ্ছে আমাদের।
‘আমরা প্রায়শই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভেজাল ও নকল ঔষধের লাগাম টানতে এবং নজরদারির ক্ষেত্রে জনসাধারণ, কোম্পানিসহ সবারই উচিত সচেতন হওয়া। নিজস্ব ঔষধের বাইরে আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য ঔষধ বা ভেজাল ঔষধ তৈরি করতে না পারে সেজন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’
এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, গত ছয় মাসে ভেজাল ঔষধ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১৪টি। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাগুলো হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মামলা ও অভিযান আরও বাড়বে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, যে ঔষধগুলো জব্দ করা হয়েছে তার সবই দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের। আমরা আহ্বান জানাব, নামিদামি কোম্পানিগুলো যেন আমাদের সহযোগিতা করে। তারা যদি কপিরাইট আইনে মামলা করে তাহলে আমাদের জন্য তদন্ত ও জালিয়াত চক্রকে ধরা খুবই সহজ হবে।
কোন এলাকায় এসব নকল ঔষধ সরবরাহ করা হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশাল এ চক্র। তারা ঢাকাকে এড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করছে।
‘আমরা গ্রেপ্তারদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করব। আদালত কর্তৃক রিমান্ড মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদে জানার চেষ্টা করা হবে, কত দিন ধরে কী পরিমাণ নকল ও ভেজাল ঔষধ তারা বিপণন ও তৈরি করেছে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ভেজাল বা নকল হওয়া নামিদামি কোম্পানিগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই একত্রে কাজ করলেই এ চক্রকে ধরা এবং ভেজাল বন্ধ করা সহজ হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল খুবই কম। তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমও নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা হয়ত সামনের দিনগুলোতে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করতে পারে। আমরা কিছুদিন আগেও ভেজাল ও নকল ঔষধ তৈরি করে এমন ৭৯টি আয়ুর্বেদিক কারখানার একটি তালিকা দিয়েছিলাম। তারা ব্যবস্থা নিয়েছে।